
ভারত থেকে বৈধভাবে আমদানি করা দেড় কোটি টাকার সামুদ্রিক মাছ আটক করার পর তা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে সিএণ্ডএফ ব্যবসায়ি আল ফেরদৌস আলফাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে চোখ, হাত ও পা বেঁধে ঝুলিয়ে অমানুষিক নির্যাতন, রিমাণ্ড না মঞ্জুর ও জামিন করিয়ে দেওয়ার নামে ৩৫ লাখ টাকা আদায় ও বিশেষ সুবিধা নিয়ে দেড় কোটি টাকার মাছ প্রায় দুই লাখ টাকায় নিলাম করনোর ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের আবুলত কাশেমের ছেলে বর্তমানে পলাশপোলের বাসিন্দা সাবেক দেবহাটা উপজেলা চেয়ারম্যান আল ফেরদৌস আলফা বাদি হয়ে বুধবার (১০ ডিসেম্বর ‘২৫) সাতক্ষীরার ১ নং আমলী আদালতে এ মামলা (সিআর-১৭৪২/২৫) দায়ের করেন।
অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম বিলাস কুমার মণ্ডল আগামি ২০ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত শাখার (সিআইডি) সাতক্ষীরার প্রধান কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আসামীরা হলেন, সাতক্ষীরা সদর সার্কেলের সাবেক সহকারি পুলিশ সুপার মীর্জা সালাহ্উদ্দিন, সদর থানার তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান, গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম, জজ কোর্টের সাবেক পিপি সদর উপজেলার কামারবায়সা গ্রামের ও বর্তমানে রসুলপুরের অ্যাড. আব্দুল লতিফ ও তার ছেলে মোঃ রাসেল।
মামলার বিবরণে জানা যায়, বাদি আল ফেরদৌস আলফা একজন সিএণ্ডএফ এজেন্ট। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর দুপুর ১টার দিকে আলফার বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানি করা দেড় কোটির টাকার সামুদ্রিক মাছ সাতক্ষীরার বাঁকাল চেক পোষ্ট এ আটক করে বিজিবি। বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও বিজিবি ট্রাক ভর্তি মাছ সাতক্ষীরা সদর থানায় পাঠায়। একজন ম্যাজিষ্ট্রেট, বিজিবি ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের সামনে তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান কাগজপত্র যাঁচাই করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয় চেম্বার অব কমার্সের এক পাঠানো ব্যবসায়ি প্রতিনিধিকে। কাগজপত্র দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। রাত ৯টার মধ্যে থানায় এসে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার জন্য আল ফেরদৌস আলফাকে ফোনে জানান থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান। রাত ১১ টার দিকে সদর সহকারি পুলিশ সুপার মীর্জা সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে ১০/১২ জন অজ্ঞাতনামা পুলিশ দুটি মাইক্রোবাসে করে এসে আল ফেরদৌস আলফার পলাশপোলের বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি করার কথা বলে দরজা খুলতে বাধ্য করেন। দোতলা ও তিন তলার ঘরে সার্চ করে কিছু না পেয়ে নীচের তলায় অফিসে নিয়ে আলফার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। আলফা তার ড্রয়ারে থাকা ১৫ লাখ টাকা দিলে তা থেকে কিছু টাকা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ও গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলামকে দেন মীর্জা সালাহউদ্দিন। পরে তাকে গুম করার উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা মহিদুলের নেতৃত্বে অজ্ঞাতনামা কয়েকেজন এক কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে আলফার দুচোখ ও দুই হাত বেঁধে গোয়েন্দা পুলিশের কথিত আয়নাঘর নামক ঘরে ঝুলিয়ে নির্যাতন করেন। ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে শৌচাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় আলফা একটি ঘরে মীর্জা সালাহউদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান ও মহিদুল ইসলামকে দেখেন। শৌচাগার থেকে ফেরার সময় মীর্জা সালাহউদ্দিন আলফাকে বলেন যে, তুই ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে মাছ এনেছিস। নির্যাতন সহ্য করবি না এক কোটি টাকা দিবি? মাছ গেছে তা আর পাবি না। জীবন বাঁচাতে কত দিবি? বৈধ কাগজপত্র আছে বলে সরকারকে রাজস্ব দিবি আর আমাদের এক কোটি টাকা দিবি না তা তো আর হয় না। ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন আলফা। টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় মোস্তাফিজুর রহমান ও মহিদুল ইসলামসহ কয়েকজন চোখ ও হাত বেঁধে আলফাকে ঝুলিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত আবারো অমানুষিক নির্যাতন করে। এসব নির্যাতনের কিছু অংশ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না মর্মে আলফা মামলায় উল্লেখ করেন। টাকা না পাওয়ায় ৩০ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে আলফাকে আবারো নির্যাতন করে একটি মাইক্রোবাসে করে বাইপাস সড়কের নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন যে, ওযু করে নে আজ তোর জীবনের শেষ দিন। তোর মাছি বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসেছি। জান ফিরে ফেতে হলে তোকে আজ রাতের মধ্যে এক কোটি টাকা দিতে হবে। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় রাতভর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে ৩১ ডিসেম্বর ভোরে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে (কথিত আয়না ঘর) এনে নামাজ ও শৌচাগারে যাওয়ার সময় ব্যতীত বাকী সময়ে হাত, পা ও চোখ বেঁধে আলফাকে আবারো নির্যাতন করা হয়। এ সময় আলফা কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এর আগে ৩০ ডিসেম্বর মোস্তাফিজুর রহমান মোবাইল করে আলফার ভাই ইউপি সদস্য আব্দুল আলীমকে থানায় ডেকে এনে চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় নির্যাতন করেন। ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে আলফা ও ভাই আলিমকে একই গাড়িতে করে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় থেকে সদর থানায় নিয়ে আসা হয়। বিকেলে তাদের দুই ভাইকে ২৯ ডিসেম্বর সামুদ্রিক মাছ অবৈধভাবে আনার অভিযোগে ৩০ ডিসেম্বর বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত মামলার (জিআর-৮৬৪/১৯ সদর) মামলায় আদালতে পাঠানো হয়। আলফাকে এজাহার নামীয় ও আলিমকে সন্ধিগ্ধ আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালত থেকে ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি এক দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করানো হয়। রিমাণ্ড আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করলে জেলা ও দায়রা জজ রিমাণ্ড আদেশ না’মঞ্জুর করেন। মীর্জা সালাহউদ্দিন , মোস্তাফিজুর রহমান ও মহিদুল ইসলাম বিশেষ ব্যবস্থায় দেড় কোটি টাকার মাছ এক লাখ ৯৫ হাজার ৯২৫ টাকায় নিলাম করিয়ে জমা দেখান। আলফা ও আলীম ১৯ দিন কারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আলফা আদালতের নির্দেশে ওই টাকা ফেরৎ পান ও মামলা খারিজ হয়।
মামলায় আরো উল্লেখ করা হয় যে, তৎকালিন জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফ ও তার ছেলে মোঃ রাসেল বাবা আলফার রিমাণ্ড না মঞ্জুর ও জামিন করার কথা বলে ছেলে আজাহারুলকে রসুলপুরের চেম্বারে ডেকে ভাড়াটিয়া মহিদুলের দিয়ে নতুন মামলা দেওয়া ও সারা জীবন জেলে রাখার ভয় দেখিয়ে ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি সাক্ষী আজাহারুলের কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা আদায় করেন। স্বতন্ত্র প্রাথী হিসেবে উপজেলা নির্বাচনে জয়লাভ করায় আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে কয়েকজন পুলিশ, জজ কোর্টের পিপির সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ধরণের নির্যাতন, হয়রানি ও টাকা লুটপাট করেছে মর্মে মামলায় উল্লেখ করা হয়ছে। ঘটনার সময় আওয়ামী লীগের প্রভাব থাকায় বাদি মামলা করতে পারেননি। বর্তমানে ড.ইউনুস সরকারের সময় সুবিধাজনক পরিস্থিতি থাকায় এ মামলা দায়ের করতে বিলম্বের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. খায়রুল বদিউজ্জামান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।