
বৃহষ্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি ‘২৫) সকালে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কাদাকাটি ইউনিয়নের মরিচ্চাপ নদীর রাধাবল্লভপুর গ্রামের মদনপাড়ার চরভরাটি জমিতে বসবাসরত ৩৫টি ভূমিহীন পরিবারের উপর হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি ‘২৫) রাতে রাধাবল্লভপুর গ্রামের আজিজুল গাজীর ছেলে জাকির হোসেন গাজী বাদি হয়ে ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৬০ জনকে আসামী করে এ মামলা (১০ নং)দায়ের করেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় দুই নারীসহ তিনজনকে শনিবার সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মামলায় বাহ্মন তেঁতুলিয়া গ্রামেরবিএনপি নেতা জহিরউদ্দিন মোড়লসহ ২৪ জন ও রাধাবল্লভপুর গ্রামের কেনা গাজী ও মোস্তফা গাজীসহ আটজনকে আসামী করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনার ৬০ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কোন আসামীকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ভূমিহীন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা বাজারে যেতে পারছে না। হামলাকারি নারীদের আসামী না করায় তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শনিবার সকালে তারা ভূমিহীনদের ঘেরের বেড়িবাঁধ কেটে দিয়েছে। নিয়ে গেছে ভাংচুরের পর পড়ে থাকা বাঁশ,ও আসবাবপত্র।
শনিবার (০১ মার্চ ‘২৫) সকালে রাধাবল্লভপুর গ্রামে যয়ে দেখা গেছে, মদনপাড়ায় বসবাসরত ভূমিহীনদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বৃহষ্পতিবার জাকির হোসেনসহ তিনটি বাড়িতে ভাংচুরের পর লুটপাট শেষে প্রেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া তিনটি বাড়ির ঘরের চালের অংশ বিশেষ ঘেরের পানিতে ভাসতে দেখা গেছে। গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তিনটি বাড়ি। সকালে ভূমিহীনদের ডিসিআর নেওয়া ঘেরের ভেড়ি কেটে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মদন গাজীর ছেলে বৃদ্ধ এলাহী বক্স গাজী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ১৭৫ দাগের ১২ একর ৩৩ শতক জমি ৩৫টি পরিবার সরকারিভাবে ডিসিআর নিয়ে দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন। এ ছাড়া ৪০ বিঘারও বেশি জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডেও কাছে ডিসিআর পাওয়ার জন্য কয়েক বছর আগে আবেদন করেছেন। ভাংড়ি কুড়িয়ে বিক্রি করে জীবন জীবিকা নির্ভর করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির করেছেন তারাই পিঠ বাঁচাতে গত বছরের ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পরপরই ভোল পাল্টে কাদাকাটি ইউনিয়ন বিএনপি’র একাংশের সভাপতি জহিরউদ্দিন মোড়লের ছাতার তলায় এসে বৃহষ্পতিবার সকালে তাদেও উপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। রাতে পুলিশ আসলেও তারা কোন আসামীর বাড়িতে ঢোকেনি। রাস্তা দিয়ে হেঁটেই তারা দায়িত্ব পালন করেছে। ফলে আসামীরা এলাকায় রয়েছে। শনিবার সকালে ব্রাহ্মণ তেঁতুলিয়ার জেনারুল সানার স্ত্রী শাহানারা খাতুন, মোস্তফার স্ত্রী বিউটি ও ইদ্রিসের স্ত্রী মর্জিনা খাতুনসহ ৭/৮জন নারী জোরপূর্বক তাদেও ঘেরের ভেড়ি কেটে দেয়। ভেঙে ফেলা ঘরবাড়ির বাঁশ ও আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যায়। চলে যাওয়ার সময় তারা বাজাওে ওঠার চেষ্টা করলে ফল ভাল হবে না বলে হুমকি দিয়ে চলে যায়। যে কারণে তারা বাজারেও যেতে পারছেন না।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরিফুল ইসলামের স্ত্রী আকলিমা খাতুন ময়না জানান, হামলাকারিদের হাতে জখম হওয়ার পর তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। স্বামীও হাসপাতালে ভর্তি । তাই বাচ্চাদের দেখাশুনা করতে শনিবার সকালে বাড়িতে এসেছেন। ভূমিহীন আল আমিন তার ডান পায়ে রক্তাক্ত জখমের চিহ্ন দেখিয়ে বলে, বৃহষ্পতিবার বাবাসহ সে হাসপাতালে যায়। বাবা ভর্তি হওয়ায় জরুরী বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তাকে বাড়িতে আসতে হয়েছে। একইভাবে নির্যাতিতদেও প্রতিবেশী শচীন গোলদারের ছেলে প্রশান্ত গোলদার বলেন, ঘটনার ভয়াবহতা এতটাই বর্বরোচিত ছিল যে, জখম হওয়া ভূমিহীনদের বাঁচাতে তিনি, তার মা সীতা রানী গোলদার ও ভাই সবুজ গোলদার বাড়ি থেকে বের হলেই তাদেরকে লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে জখম করা হয়। ভাই সবুজকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বাড়ির জিনিসপত্র লুটপাট বন্ধ করতে তিনি ও মা বাড়িতে থেকে টুকু ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মত আরো কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হননি বলে জানান প্রশান্ত গোলদার।
তবে ঘটনাস্থলের পাশে অবস্থানকরা ব্রাহ্মণ তেঁতুলিয়া গ্রামের ইদ্রিস আলীর স্ত্রী মর্জিনা খাতুন, মোস্তফার স্ত্রী বিউটি খাতুন ও জেনারুল মোড়লের স্ত্রী শাহানারা খাতুনসহ কয়েকজন জানান, ওই জমির পিছনে তাদের রেকডীয় জমি। তাই ওই জমিতে ভূমিহীনরা ডিসিআর কেটে বসবাস করবেন সেটা মেনে নিতে পারেনি। তাই হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়েছে। তবে ঘেরের ভেড়ি কাটার কথা অস্বীকার করেন তারা।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা আশাশুনি থানার উপ-পরিদর্শক শ্যামাপ্রসাদ রায় জানান. সকালে মহিলারা ভূমিহীনদের ঘেরের ভেড়ি কেটে দিয়েছে মর্মে জানতে পেরে দফাদারকে পাঠিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর আবারো ঘটনাস্থলে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আসামী গ্রেপ্তারে চিরুনি তল্লাশি চালানো হবে।
প্রসঙ্গত, গত বৃহষ্পতিবার সকাল সাতটার দিকে কাদাকাটি ইউনিয়ন বিএনপি’র একাংশের আহবায়ক ব্রহ্মণ তেঁতুলিয়া গ্রামের জহিরউদ্দিন মোড়লের নেতৃত্বে শতাধিক সন্ত্রাসী রাধাবল্লভপুর গ্রামের মদনপাড়ায় ভূমিহীন জনপদে সশস্ত্র হামলা জালায়। তারা প্রথমে জাকির হোসেন গাজীর বাড়িতে ঢোকার সময় জাকির ও তার পরিবারের সদস্যরা এক বস্ত্রে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। তাদেরকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ব্রাহ্মণ তেঁতুলিয়া গ্রামের আবু সাঈদ মোড়ল, একই গ্রামের রইচউদ্দিন মোড়ল, নজরুল সরদার, জহিরউদ্দিন মোড়ল, মুজিবর মোড়ল, আরাফাত মোড়ল, অহিদুল মোড়ল, আল মামুন, আলাল, তার ভাই ইদ্রিস মোড়ল ঘরের আলমারি, শোকেসসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাংচুর করে। বাড়ি থেকে তারা সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা মূল্যেও পাঁচ ভরি সোনার গহনা ও ব্যবহারিক জিনিসপত্র লুট করে। বাড়ির দুই লাখ টাকা মূল্যের আসবাবপত্র ভাংচুর করে। এ সময় তারা জাকির হোসেন, তার বাবা ও ছোট দাদার বাড়িঘর প্রেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। শরিফুল মোড়ল, ইব্রাহীম মোড়ল, জাহাঙ্গীর মোড়ল, মামুন মোড়ল, জনি মোড়ল, লুৎফর মোড়ল, সালাম মোড়ল, ইউনুস মোড়ল, শাহীন ও সোহাগ সরদার অস্ত্র উচিয়ে উল্লাস করতে করতে ভূমিহীনদের লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি দেয়। একই গ্রামের হান্নান মোড়ল, শরবৎ মোড়ল, হাবিবুল্লাহ মোড়ল, সবুজ মোড়ল, রাধাবল্লভপুর গ্রামের কোন গাজী, মোজাম গাজী, রবিউল মোড়ল, রফিকুল মোড়ল, জিনারুল মোড়ল, সাইদুল মোড়ল, নূর ইসলাম মোড়ল ও বাব মোড়লসহ অজ্ঞাতনামা ৪০/৫০ জন বস্তার মধ্যে বোমা আছে উল্লেখ করে ভূমিহীনদের বুকে বোমা মেরে বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়ার হুমকি দেয়। তাদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলে ভূমিহীনদেরবাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে লুটপাট ও ভাংচুর চালায়। হামলা ভাংচুর ও লুটপাটে বাধা দেওয়ায় সাতজন নারীসহ কমপক্ষে ২০ জন জখম হয়। এ ঘটনার নেপথ্যে জাকির হোসেন মোড়ল নামে এক এএসআই নেপথ্যে পুলিশকে ম্যানেজ করার ভূমিকা পালন করে। এ ঘটনায় নির্যাতিত জাকির হোসেন গাজী বাদি হয়ে বিএনপি নেতা জহিরউদ্দিন মোড়লসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখ কওে ২০০২ সালের সংধোধিত ২০০৯ এর দ্রুত বিচার আইনের ৪/৫ ধারায় তৎসহ পেনাল কোডের ১৪৩/১৪৭/৪৪৮/৪৪০/৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩৫৪/৩৭৯/৩৮০/৪২৭/৪৩৬/৫০৬/১১৪ ধারায় শুক্রবার থানায় মামলা দায়ের করেন।