বাড়ি ঘিরে হাজারো মানুষ, কেউ বিলাপ করছেন, কেউ তার প্রশংসা করছেন। শনিবার সকালে এমন একটি দৃশ্যের অবতারনা ঘটলো সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর সাহাপাড়ায়। পাশেই পূজামন্ডপ। মন্ডপের মাঠেও শুভাকাঙ্খীদের ভিড়। তাদের একটাই কথা, অপরেশ দা চলে গেছেন। আর কোনদিন তিনি মৃদু কন্ঠে হাসি ছড়িয়ে কথা বলবেন না।আজ সাতক্ষীরার প্রখ্যাত কৃষকনেতা সাইফুল্লাহ লস্করের ১১ তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সময় এখবর ছড়িয়ে পড়লো, অপরেশ দা মারা গেছেন। ৫ ডিসেম্বর এই দুটি মৃত্যু একসাথে যুক্ত হলো।হৃদরোগ তাকে হাতছানি দিচ্ছিলো। বারবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। চিকিৎসা নেন কখনও হাসপাতালে আবার কখনও বাড়িতে। শেষ পর্যায়ে এসে আর্থিক অনটনে ওষুধ কেনার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেন তিনি। আর সেখানেই ঘটলো বিপত্তি। শুক্রবার দুপুরে ফের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত ১১টা ৪ মিনিটে তার প্রানবায়ু নিঃশেষ হয়ে যায়।
১৯৫৬তে জন্মগ্রহনকারী অপরেশ পাল কলারোয়ার মুরারীকাটি থেকে সাতক্ষীরা সুলতানপুরে চলে আসেন। তার বাবা প্রয়াত গৌর পাল ছিলেন একজন বড় মাপের ব্যবসায়ী। পিএন স্কুল থেকে এসএসসি ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী নেওয়ার পর তিনি প্রগতিশীল বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে রাজনৈতিক কারণে তিনি গ্রেফতার হন। কয়েক মাস যশোর জেলে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়েই তিনি চলে যান ভারতে।
মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে বসে মুক্তিযুদ্ধে স্বপক্ষে প্রচারনা চালাতে থাকেন। মহান বিজয় দিবসের পর ১১ ডিসেম্বর তিনি সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে তিনি মহাকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় সভাপতি ছিলেন বর্তমানে ফ্রান্সে অবস্থানরত ওয়ারেশ খান চৌধুরী। ১৯৮২ সালে সালে অপরেশ পাল ওয়ার্ল্ড ভিশন এডিপি’র সঙ্গে জগিয়ে উন্নয়ন কাজে অংশ নেন। ২০০৩ সালে তিনি নিজেই গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ভিশন নামের একটি বেসরকারী সংস্থা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ছিলেন তিনি। আমৃত্যু একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করে গেছেন।
তিনি সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র), আমরাই পারি জোট, সুইপ খুলনা, মানবাধিকার সংগঠন সহ বিভিন্ন অরাজনৈতিক অথজ উন্নয়ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। অত্যন্ত সদালাপী, মৃদুভাষী অপরেশ পাল ছিলেন সাতক্ষীরার সব মানুষের কাছে একটি পরিচিত মুখ। তার সাধাসিধে আচরন এবং যেকোন সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন, এসিড সন্ত্রাস, বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন সহ নানা আন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে অপরেশ পাল নিজেকে অনেকটাই অব্যয়, অক্ষয় করে রেখে গেছেন। তিনি মৃত্যুর পর তার চোখ দু’টি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। মৃত্যুর পর তার লাশ ধুলিহর মহাশ্মশানে দাফনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
মাত্র ক’দিন আগে সাতক্ষীরার সামগ্রিক মানবাধিকার বিষয়ক এক আলোচনা সভায় তিনি দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এসময় এই প্রতিবেদনের লেখকও উপস্থিত ছিলেন। অপরেশ পাল এসময় বলেন, নারী নির্যাতন রোধ করতে হবে। শিশু নির্যাতন রোধ করতে হবে। ধর্ষনের মত অপরাধ রুখতে হবে। মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। মানুষের বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যা, শিশু হত্যা ও নির্যাতন সহ সমাজের সকল ধরনের দূর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের ফসল একদিন আমরা সবাই উপভোগ করবো। অপরেশ পালের সেই কথাগুলি এখনও কানে বাজছে।
তিনি আর আসবেন না, আর কথা বলবেন না, হৃদরোগের হাতছানি তাকে তুলে নিয়ে গেল। হৃদরোগের কাছে তিনি হার মেনেছেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও দু’ ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহীকে রেখে গেছেন। শনিবার দুপুরে সাহাপাড়া মন্দিরের মাঠে তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠণের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রওতিনিধিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠণের নেতা ও কর্মীরা। শনিবার বিকেলে ধুলিহর মহাশ্মশানে তার শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়।