ছয়ঘরিয়ার জোড়া শিব মন্দির, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলাধীন ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া গ্রামের প্রাচীন জমিদার বাড়ির দুই শতাধিক বছরের পুরোনো একজোড়া শিবমন্দির, প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটার ফলক থেকে জানা যায় যে, এই অঞ্চলের তৎকালিন জমিদার ফকির চাঁদ ঘোষ প্রজাদের পূজার্চনার সুবিধার্থে ১২২০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ (১৫ই এপ্রিল ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে) এই দুইটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ভক্তদের স্নানের সুবিধার্থে মন্দির দুইটির লাগোয়া ১ একর ৩১ শতক জমিতে একটি বিশাল দিঘি খনন করেছিলেন। মন্দির দুইটি সেই দিঘির উত্তর পাড়ে পাশাপাশি অবস্থিত।
সাতক্ষীরা জেলাশহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে এই জোড়া শিবমন্দিরের অবস্থান। গ্রামীণ আটচালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দুইটি মন্দিরই একই আকার ও নকশায় সমৃদ্ধ। মন্দির দুইটির গায়ে খুব সুন্দর টেরাকোটার কাজ রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের সহজেই আকর্ষণ করে। দুইটি মন্দিরই বর্গাকৃতির, প্রতিটি বাহু ১৫ফুট-৯ইঞ্চি মাপের। বৈচিত্র্যপূর্ণ টেরাকোটার ইটে নির্মিত মন্দির দুইটি। ফুল, লতা-পাতা, পরী, বাদক, অশ্বারোহী, দেবদেবী, হাতি-আরোহী ইত্যাদি চিত্রে এইসব টেরাকোটা সমৃদ্ধ। সাতক্ষীরা জেলায় যতগুলি টেরাকোটা শিল্প সমৃদ্ধ স্থাপত্য আছে তার মধ্যে ‘ছয়ঘরিয়ার জোড়া শিবমন্দির’এর টেরাকোটার কাজগুলি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়।
জমিদার ফকির চাঁদ ঘোষের পরবর্তী বংশধর জমিদার কালীপদ ঘোষ এবং অন্যান্য শরিকেরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে মন্দির দুইটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। অনেকদিন পরে ১৪১৯ বঙ্গাব্দে ছয়ঘরিয়া গ্রামের মনোরঞ্জন রায় এই মন্দিরগুলি সংস্কার করেন এবং ৭১ বছর পরে ১৪২০ বঙ্গাব্দের ২৯শে চৈত্র তারিখ এই মন্দিরে পুনরায় পূজার্চনা শুরু হয়। ১৪২২ বঙ্গাব্দের ৩১শে বৈশাখ সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক এই স্থাপনাটি তালিকাভুক্ত করণ সংক্রান্ত একটি সাইনবোর্ড এখানে স্থাপন করা হয়। অবশ্য উক্ত দপ্তর কর্তৃক সাইনবোর্ড স্থাপন ছাড়া আর কোন সংস্কার বা উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পাদনের কথা জানা যায়না।
প্রায় ৪/৫ বছর আগে ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে দিঘির উত্তর পাড়ে মন্দির দুইটির লাগোয়া এলাকাটি শান দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয় এবং মন্দির দুটিকে অনেকটা দৃষ্টিনন্দন করা হয়। তবে এই সংস্কার যথেষ্ট নয় বলে সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করেন। কারন মন্দির দুইটির ছাদ ফেটে গেছে, ছাদ এবং দেওয়াল থেকে ছোট ছোট অংশ ভেঙে পড়ছে। এমতাবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে মন্দির দুইটির ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এর জন্য অতি শিঘ্র স্থানীয় সরকার ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। একমাত্র সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সাহায্যেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মন্দির দুইটিকে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
সাতক্ষীরায় ‘ছয়ঘরিয়ার জোড়া শিবমন্দির’ বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এর অপূর্ব সুন্দর টেরাকোটার আকর্ষণে অনেক পর্যটক এই স্থাপনাটি দেখার জন্য এখানে আসেন। তবে মন্দিরগুলি সংস্কার করা হলে এবং এই স্থাপনা সম্পর্কে প্রচার বৃদ্ধি করা হলে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে এর আবেদন অনেকটাই বেড়ে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।