২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট সাতক্ষীরায় কলারোয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলার ১৮ বছর অতিক্রান্ত। মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ মিফতাহউদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি এএনএম বসিরউল্লাহ এর সমম্বয় গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ গত ২০১৭ সালের ৯ আগষ্ট পৃথক দু’টি আদেশে ও একই বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৩ আগষ্ট অপর এক আদেশে তিনটি মামলার কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দেন। অদ্যাবধি স্থগিতাদেশ খারিজ না হওয়ায় মামলার বিচার কার্যক্রম আবারো থমকে যায়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট সকাল ১০টায় তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আসেন। সেখান থেকে যশোর ফিরে যাওয়ার পথে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে রাস্তার উপর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও তৎকালিন সাংসদ হাবিবুল ইসলাম হাবিব ও বিএনপি নেতা রঞ্জুর নির্দেশে বিএনপি ও যুবদলের নেতা কর্মীরা দলীয় অফিসের সামনে একটি যাত্রীবাহি বাস (সাতক্ষীরা-জ-০৪-০০২৯) রাস্তার উপর আড় করে দিয়ে তার গাড়ি বহরে হামলা চালায়। হামলায় তৎকালিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মতিন, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সাথী ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে এক ডজন দলীয় নেতা কর্মী আহত হয়।
এ ঘটনায় থানা মামলা না নেওয়ায় ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর কলারোয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলমউদ্দিন বাদি হয়ে যুবদল নেতা আশরাফ হোসেন, আব্দুল কাদের বাচ্চুসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৭০/৭৫ জনকে সাতক্ষীরা নালিশী আদালত ‘ক’ অঞ্চলে একটি মামলা (সিআরপি-১১৭১/০২) দায়ের করেন। মামলায় ১৮জনকে সাক্ষী করা হয়। বিচারক এম আই ছিদ্দিকী তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম গোলাম কিবরিয়াকে নির্দেশ দেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
বারবার তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে যেয়েও তিনি জবানবন্দি না নিয়ে নিজের মনগড়া কথা ১৬১ ধারার জবানবন্দি হিসাবে উল্লেখ করেছেন বলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এফিডেফিড দিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় হাজির হয় বিচারককে অবহিত করেন সাক্ষী ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন, শওকত হোসেন, শহীদুল ইসলাম, প্রভাষক জাভিদ হাসান, আমিনুল ইসলাম লাল্টু ও আলতাফ হোসেন লালু।
বাদি মোসলেমউদ্দিন পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে ২০০৪ সালের ২২ জানুয়ারি নারাজির আবেদন জানালে শুনানী শেষে তা খারিজ হয়ে যায়। এ খারিজ আবেদনের বিরুদ্ধে বাদি ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা ( ১৭/০৪) দায়ের করেন। ২২ এপ্রিল শুনানী শেষে বিচারক এ রিভিশন আবেদন খারিজ করে দেন। ২০০৪ সালের ৪ আগষ্ট বাদি এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন ক্রিমিনালে মিস কেস (৫৮৯৩/০৪) দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানী শেষে বিচারকদ্বয় ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই আপিল মঞ্জুর করে নিম্ন আদালতের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ দেন। একইসাথে নিম্ম আদালতে মামলার কার্যক্রম নতুন করে শুর করার করার জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। আদেশের কপি দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর ফাইলবন্দী থাকার পর ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এসে পৌঁছায়। ১৭ সেপ্টেম্বর বাদির উপস্থিতিতে নারাজির শুনানী করার জন্য মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। ওই দিন তিনি অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। পরবরর্তীতে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) শফিকুর রহমান ৫০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোপত্র দাখিল করেন। মামলাটি তিনটি ভাগ ভাগ হয় এসটিসি ২০৭/১৫, এসটিসি ২০৮/১৫ দু’টি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-২য় আদালতে বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এ মামলায় বাদি সাক্ষী দিতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অপর টিআর ১৫১/১৫ মামলাটি মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে বিচারাধীন। মামলায় বাদি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ মোসলেমউদ্দিন, কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু, শহীদুল ইসলাম, কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আহবায়ক সাজিদুর রহমান চৌধুরী মঞ্জু, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সাংসদ প্রৌকশলী শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড. আজাহারল ইসলামসহ নয়জন আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এ মামলার পরবর্তী সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য করা হয়।
এসটিসি ২০৭/১৫, ২০৮/১৫ এ দু’টি মামলায় ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এ আদালতে বাদিসহ একজন সাক্ষী দিতে এলে আসামী পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. আব্দুল মজিদ (২) ও অ্যাড. মিজানুর রহমান পিণ্টু অভিযোগপত্রে উল্লেখিত আলতাফ হোসেনসহ ৩১ জনের দায়েরকৃত ৮৫৫৯/১৭ ও ৮৫৬০/১৭ নং ক্রিমিনাল মিস কেস এর প্রেক্ষিতে গত ৯ আগষ্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ মিফতাহউদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি এএনএম বসিরউল্লাহ এ আদালতে বিচারাধীন দু’টি এসটিসি মামলার কার্যক্রমের উপর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন বলে বিচারককে অবহিত করেন। এ দু’ টি মামলার ডেপুটি এটর্ণি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাতক্ষীরারই সন্তান অ্যাড. শেখ একেএম মনিরুজ্জামান। একইভাবে মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের কাঠগোড়ায় বাদি মোসলেমউদ্দিন( টিআর- ১৫১/১৫ মামলা) কাঠগড়ায় উঠলে আসামী পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. আব্দুল মজিদ(২) কম্পিউটার কম্পোজকৃত একটি কাগজ দেখিয়ে বলেন যে. এ মামলার আসামী রকিবুর রহমানের দায়েরকত ৩৭৭৯৯/১৭ নং ক্রিমিনাল মিস কেস দায়ের করলে ২০১৭ সালের ২৩ আগষ্ট মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ মিফতাহউদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি এএনএম বসিরউল্লাহ এর সমম্বয় গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ এ মামলার কার্যক্রমের উপর চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন। যদিও ওই মিস কেসের সত্যায়িত বা মুল কপি সংশিষ্ট আদালতে না পৌঁছানায় ৭ সেপ্টেম্বর সাক্ষীর কার্যক্রম স্থগিত করে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা আদালতে জমা দেওয়ার জন্য আসামী পক্ষের আইনজীবীদের নির্দেশ দেন। ওই দিন আসামী পক্ষের আইনজীবীরা হাইকোর্টের আদেশ সংক্রান্ত সত্যায়িত কপি আদালত উপস্থাপন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু জানান, এসটিসি ২০৭/১৫, ২০৮/১৫ এ দু’টি মামলায় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতে বাদি মোসলেমউদ্দিন ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এ আদালতে সাক্ষী দিতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সাক্ষী চলাকালিন আসামী পক্ষের আইনজীবী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. আব্দুল মজিদ (২) বাদিকে চাপ সৃষ্টি করেছেন এমন অভিযোগ মোসলেমউদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এমন অভিযোগ জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। তবে টিআর- ১৫১/১৫ মামলায় মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এ পর্যন্ত নয়জন সাক্ষী দিয়েছেন। তবে নেত্রীর সঙ্গে থাকা আহত ঢাকার কয়েকজন সাক্ষীর জবানবন্দি দ্রুত নিতে পারলে ২০১৭ সালেই এ মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষ হতে পারতঝ। একইভাবে বিএনপি নেতা অ্যাড. আব্দুস সাত্তার ও বিএনপি কর্মী জহুরল ইসলাম রিভিশনের নামে যেভাবে মামলার কার্যক্রম ব্যহত করছেন সেভাবে আর কোন বিঘ্ন না হলে এসটিসি-২০৭/১৫ ও এসটিসি-২০৮/১৫ নং মামলা দুটিও দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার সূযোগ থাকলেও ওই বছরের ৯ ও ২৩ আগষ্ট হাইকোর্টের পৃথক তিনটি আদেশে মামলা তিনটির কার্যক্রম স্থগিত হয় যাওয়ায় বিচার কার্যক্রম আবারো থমকে যায়। জেলা ও দায়রা জজ কোর্টের তৎকালিন পিপি অ্যাড. ওসমান গণি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. শাহ আলমসহ বিশিষ্ঠ আইনজীবীরা মামলার স্থগিতাদেশ খারিজ করতে এটর্ণি জেনারলের কাছে বার বার ছুঁটলেও করোনা পরিস্থিতিসডহ বিভিন্ন কারণে আজো খারিজ আবেদন শুনানী করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে মামলার বাদি কলারোয়া উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলেমউদ্দিন জানান, বার্ধক্যর কারণে অসুস্তার পরও তিনি শেষ পর্যন্ত এসটিসি দু’টি মামলায় সাক্ষী দিতে নিজকে প্রস্তত করেছিলেন। বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। এ বিচারের রায় দেখা যেতে পারা নিয়ে তিনি সংশয় রয়েছেন।