চাচাতো ভাই আব্দুস সালাম বৃহষ্পতিবার রাতে দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছে। তার দাফনের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা ইউনিয়নের কোথায় না পেয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে খাজরা খৈয়া ঘাটে শুক্রবারে দাফন করেছি। প্রতাপনগর ইউনিয়নটি এখন পানিতে ভাসছে। এমন কোন বাড়ি নেই যে বাড়িতছ বুকে সমানে পানি উঠছে না। আমরা এখন কোথায় যাবো?
কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে শাহীনুর রহমান, বৃদ্ধা আব্দুস সাত্তারসহ অনেকেই বলেন, বিগত ৪০ বছর প্রতাপনগর ইউনিয়নের এভাবে তলিয়ে যেতে দেখিনি। এতো পানি কোথা থেকে আসছে।
তারা বলেন, প্রতিদিন বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে ইউনিয়নবাসীর দু:খ কষ্ট। বেলা ১১টার দিকে থেকে শুর হয়ৈ জোয়ারে প্রবল বেগে হু হু করে ভাঙ্গা স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ করে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিকাল ৫টার পর ভাটার টানে কিছুটা পানি সরে গেলেও বসবাসের মত পরিবেশ নেই। চারিদিকে পানি আর পানি। কষ্টের যেন শেষ নেই মানুষের।
সরজমিনে ঘুরে জানা গেছে, সুপার সাইক্লোন আম্ফান, বুলবুলসহ বড় বড় ঘুর্ণিঝড় প্রতাপনগর ইউনিয়নে এতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মাত্র দুইদিনের জলাছ্বাস ইউনিয়নের রিং বাধগুলো ভেঙ্গে এ অবর্ণনীয় কষ্টের জোয়ারে ভাসছে তারা। ইউনিয়নের গড়ইমহল কালভার্ট সংলগ্ন প্রধান পিচ ঢালা রাস্তা ভেঙ্গে গেছে। কল্যাণপুর ক্লিনিক মোড় থেকে তালতলা বাজার পর্যন্ত সকল রাস্তা ছাঁপিয়ে জোয়ারের পানি সকল জায়গায় প্রবেশ করছে।
ফলে ইউনিয়ন সদরের সাথে যঝগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। জ্বলোছ্বাস ঘুর্ণিঝড় আম্পানে প্লাবন জোয়ার আজও ডুবে আছে কৃষকের সাধের সবুজ ফসল ভরা খেত খামার। স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গবাদিপশু, খামারিদের সবই ভাসিয়ে দিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি আম্পান! আজও জোয়ার ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে ভুক্তভোগী প্লাবিত এ অঞ্চলের মানুষের। বাসগৃহ ভেঙ্গেছে শতশত পরিবারের। টোং বেঁধে বসবাস করছে শতশত পরিবার। আজও বাধ্য হয়ে আশ্রয় কেন্দ্র থাকতে হচ্ছে অনেক পরিবারের। বিপন্ন দুর্বিষহ জীবন যাত্রার শেষ হবে কবে?
একই অবস্থা আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা এবং দ্বীপ ইউনিয়ন শ্যামনগরের গাবুরাতেও।
উপায় অন্ত না পেয়ে তলপিতলপা গুছিয়ে এলাকা ছাড়ছেন অনেকেই। তবে যাদের যাওয়ার মত জায়গা নাই তারা পড়ছেন বিপাকে। সাইক্লোন শেল্টারগুলো কানায় কানায়পূর্ণ, উচুঁ জায়গাগুলো গরু ছাগল রেখে কোন রকম বেঁচে থাকার চেষ্টা সেখানকার মানুষের।
তবে রিং বাঁধ ভেঙ্গে পুনরায় প্লাবিত হওয়ায় প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দুষছেন ইউনিয়নের মানুষ।
গত ২০ মে আম্ফানের আঘাতে সাতক্ষীরার উপকুলীয় অঞ্চল আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আনুলিয়া, খাজরা এবং শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি বেড়ীবাধ ভেঙ্গে যায়। প্লাবিত হয়ে পানি বন্দী হয়ে পড়েছে এসব এলাকার লাখো পরিবার। অথচ আম্ফানের ৩ মাস অতিবাহিত হলেও সে সব স্থানে বেড়ী নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। স্বেছাশ্রমের ভিত্তিতে রিং বাঁধ দেওয়া হলেও গত দুই দিনের প্রবল বর্ষণ রিং বাঁধগুলো ভেঙ্গে নতুন করে প্লাবিত হয়ে এসব এলাকা।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, তার ইউনিয়ন লেবুবুনিয়া, গাবুরা ও খলসিখালী তিনটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত। তবে, হাজার হাজার এলাকাবাসীকে নিয়ে স্বেছাশ্রমে কোন রকমে ছয়টি স্থানে রিংবাধ দিলেও দুপুরের জোয়ারে চারটি স্থান তা আবারও ভেঙ্গে গেছে। এতে তার ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজারের অধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে।
এবিষয় আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মীর আলিফ রেজা বলেন, আশাশুনির বানভাসী মানুষের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় ২৫ মে.টন চাউল বরাদ্দ দিয়েছেন। পানি বন্দী মানুষগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দ্রুত বেড়ী নির্মাণের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কথা হয়েছে। ইতোমধ্যে হাজরাখালীতে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই বৃষ্টির কারণে তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তারা বলেছেন নভেম্বর আগে আর সেখানে বাঁধ নির্মাণ সম্ভব না।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (১) নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু সরকার বলেন, নিম্নচাপ এবং জোয়ারের প্রচন্ড বেগে থাকায় রিংবাধগুলো ভেঙ্গে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমার দ্রুত পানি বন্দি মানুষগুলোকে রক্ষার জন্য শনিবার একটি পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করবো।