সাতক্ষীরায় দুই দিন ব্যাপী ”ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে” নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কিত হ্যান্ডবুক প্রচার বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা সভা এবং শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে অত্র প্রকল্পের কৌশল সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া গ্রহন করা হয়েছে।
১২ ও ১৩ আগষ্ট বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুপুরে বে-সরকারী সংস্থা অগ্রগতির আয়োজনে পি টি আর সি অডিটোরিয়ামে ”ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ প্রকল্প” কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর সহযোগীতায় অগ্রগতি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সবুর বিশ্বাসের সভাপতিত্বে, প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মাসুম বিল্লাহ সোহগের সঞ্চালনায় CRDF সদস্য ও শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে উপস্থিত ছিলেন তালতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, পুলিশ লাইন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পলাশপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, আগরদাঁড়ী আমিনিয়া কামিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক, খেজুরডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক, ধারপোতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, শহীদ খোকন স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রমুখ।
এসময় বক্তারা বলেন, মা-বাবা ও অভিভাবকগণ শিশু যৌন নির্যাতন তখনই প্রতিরোধ করতে পারবেন যখন তারা নিজেরা বুঝতে পারবেন শিশুর প্রতি কী কী ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে পারে এবং কীভাবে তা থেকে রক্ষা করা যায়।
#ঘটনাগুলো অপ্রকাশিত থাকার কারণ:
যৌনসংক্রান্ত কথাবার্তা বলা বা এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করার বিষয়টি এখনও লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়। সামাজিকভাবে অপদস্ত হওয়া, ভবিষ্যতে শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা বা জল্পনা-কল্পনার অবকাশ এত বেশি থাকে যে, শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে চাপা দিতে তৎপর থাকে শিশুর পরিবার। বেশিরভাগ ঘটনাগুলো অপ্রকাশিত থাকার এটিই অন্যতম কারণ। চরম নিষ্ঠুরতা নিয়ে আলোচনা বা মা-বাবা কিংবা শিক্ষক হিসেবে আপনার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা আছে, এই ভেবে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আপনার কর্তব্য। সেইসঙ্গে সঠিক ব্যবস্থাপনায় শিশুর ভয়ভীতি কাটিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করতে হবে। তা না হলে শিশুটি এর ক্ষতিকর প্রভাব পুরো জীবন জুড়ে বহন করে চলবে।
#শিশু যৌন নির্যাতন কী?
অপরাধীরা সাধারণত সন্তান ও মা-বাবার মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতারই সুযোগ নিয়ে ঘটনা ঘটায়। কী ধরনের আচরণকে শিশু যৌন নির্যাতন হিসেবে ধরা যেতে পারে এ সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উল্লেখ করেছে যে, শিশুদের প্রতি যে কোনো যৌন কার্যকলাপ বলতে বোঝায় যে সম্পর্ক সম্বন্ধে শিশুর কোনো ধারণা নেই, যাতে সে সম্মতি দিতে পারে না এবং যেসব কার্যকলাপের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সে প্রস্তুত নয়। সুতরাং শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার অন্তরায় এমন যে কোনো যৌন আচরণই যৌন নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা হবে।
শিশু যৌন নির্যাতন নানা প্রকারে হতে পারে। শারীরিক স্পর্শজনিত নির্যাতনই যে কেবল যৌন নির্যাতন তা কিন্তু নয়। অপরাধী যদি নিজের গোপন অঙ্গ দেখায় বা শিশুদের গোপন অঙ্গ স্পর্শ করে, কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করে, খারাপ কথা বলে বা মেসেজ পাঠায়-এসব কর্মকাণ্ডও যৌন নির্যাতন হিসেবে ধরা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে ৯০% শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনা তাদের খুব কাছের মানুষদের দ্বারাই ঘটে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী হয় পুরুষ। সাধারণত সম্পর্কে বড়ো, যারা শিশুর ওপর প্রভাব খাটাতে পারে তারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। তারা ছোটো, তাই তাদেরকে কথা শুনতে বাধ্য করা যায়, কোনো সন্দেহ সৃষ্টি না করে সহজেইতাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব। এই ধরনের নির্যাতন শিশুকে দীর্ঘদিন মানসিক যন্ত্রণা তো দিয়েই থাকে সেইসঙ্গে অনেকসময় শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
#পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হওয়া জরুরি :
শিশু সুরক্ষা নীতির প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে যৌন নির্যাতনের ধরনধারণ ও পরিধি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ। এই প্রক্রিয়া শুরু হতে হবে নিজের ঘর থেকেই। বাড়িতে এমন একটি সহজ-সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে যেখানে শিশুরা মা-বাবাকে নির্দ্বিধায় সব কথা খুলে বলতে পারে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করা কঠিন, আরও কঠিন হয় যখন নির্যাতনকারী পরিবারের কাছের কেউ হয়-বেশিরভাগ সময়ে তা-ই ঘটে থাকে। শিশুরা অনেকক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে পারে না কিন্তু বিভিন্নভাবে তাদের ভয়-আতঙ্ক প্রকাশ করে।
#সন্তানের আচরণের প্রতি সচেতন হোন :
সাধারণত মেয়ে শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। তবে ছেলেরাও হতে পারে। এর ফলে কারও কারও স্বভাবে পরিবর্তন ঘটে। কেউ কেউ বেশি মা-বাবার কাছাকাছি থাকতে চায় আবার কেউ কেউ কারও সঙ্গে মিশতেই চায় না। কারও কারও মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরভাব, পড়ালেখায় অমনোযোগীতা, ক্ষুধামান্দ্য বা খাবার প্রবণতা বেড়ে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক আচরণ হয় আরও ভিন্ন মাত্রায়। যেমন-বিছানা ভেজানো, আঙুল চোষা ইত্যাদি অভ্যাস পুনরায় ফিরে আসে। এই আচরণগুলো যৌন নির্যাতনকে প্রমাণ করে না ঠিকই, কিন্তু শিশুর আচরণে যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া উচিত এবং কেন করছে তা জানার চেষ্টা করা উচিত।
শিশু নির্যাতনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া যতোটা প্রয়োজন ততোটাই প্রয়োজন নিজেদের সচেতন হওয়া। নির্যাতিত হয়েছে বা আমরা ধারণা করছি নির্যাতিত হতে পারে এমন শিশুর কথা অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। শিশুটি হয়তো কী ঘটেছে তা বুঝতে পারছে না কিন্তু খারাপ লাগছে।
#আমরা যা করতে পারি :
মা-বাবা বা অভিভাবক যদি মনে করেন তাদের সন্তান যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাহলে হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারেন, যা আমাদের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। নিশ্চিত হলে নিকটবর্তী থানায় অভিযোগ দায়ের করুন এবং আক্রান্ত শিশুকে অবশ্যই পেশাগত মনো-সামাজিক কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যাবেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তাকে কাউন্সেলিং করুন।
এটাই স্বাভাবিক যে, মা-বাবারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তার সন্তানকে রক্ষা করতে। এরপরও বাংলাদেশে শিশু যৌন নির্যাতনের যে পরিসংখ্যান তা সত্যিই ভয়ঙ্কর। এর প্রতিরোধে যে পদক্ষেপই আমরা নিই না কেন, তার শুরু হতে হবে আপন ঘর থেকে। তাদেরকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে, যাদের প্রতি শিশুরা সবচাইতে বেশি আস্থাশীল-তারা হলেন শিশুর মা-বাবা।
উক্ত কর্মশালায় দুই দিনে ৬০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী অংশ গ্রহন করেন।