
প্রায় এক বছর যাবৎ মিথ্যা মামলার যন্ত্রণা নিয়ে গ্রেপ্তারি এড়াতে আত্মগোপনে থেকে চরম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রদূত পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি সদালাপী মনিরুল ইসলাম মনি। শনিবার (২০ ডিসেম্বর ‘২৫ সকাল ১০টার দিকে সে মস্তিস্কে রক্ষক্ষরণ জনিত রোগে (ব্রেইন স্ট্রোক) মারা যায়।
মনিরুল ইসলাম মনি (৪৮) সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাচিমপুর গ্রামের মৃত আব্দুল আহাদের ছেলে।
ঝাউডাঙা ডিগ্রী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও হাচিমপুর গ্রামের আল আসকা সাজু জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে তার বাবা মানিরুল ইসলাম মনি দৈনিক পত্রদূতের ঝাউডাঙা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীতে তাকে নিজস্ব প্রতিনিধি করা হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স.ম আলাউদ্দিন সম্পাদিত ও প্রকাশিত দৈনিক পত্রদূতের জন্য তার বাবা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
ঝাউডাঙা সীমান্ত থেকে বেশী দূরে না হওয়ায় চোরাচালান, ধুড় পাচার, নারী ও শিশু পাচার, সরকারি কর্মকর্তাদের দূর্ণীতি, ঝাউডাঙা বাজারের পেরিফেরি জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, বেতনা নদীর চর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, ঝাউডাঙা শ্মশানের জায়গা দখল, জগন্নাথ দেব এর মন্দিরের জায়গা দখল করে ঘর নির্মাণের চেষ্টাসহ বিভিন্ন অনিময় ও দূর্ণীতির বিরুদ্ধে তার বাবার কলম ছিল সোচ্চার। এজন্য তার বাবাকে বিভিন্ন সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয়।
২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ঝাউডাঙা বাজারে জামায়াতের অবস্থান কর্মসুচি চালানোর সময় পুলিশের গুলিতে গোবিন্দকাটি গ্রামের লোকমান সরদারের ছেলে ভ্যান চালক হাফিজুর রহমান মারা যান।
এ ঘটনায় চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি নিহত হাফিজুর রহমানের দুলাভাই সলেমান সরদার বাদি হয়ে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৪৩ জনের নাম উল্লেখসহ ১৫/২০ জনকে আসামী করা হয়। আদালতের নির্দেশে মামলাটি এফআইআর হিসেবে গণ্য হয়। এ মামলায় তার বাবাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আসামী করা হয়। একইভাবে ঘটনার সময় বিদেশে থাকলেও তাদের গ্রামের আবেদ আলীর ছেলে আব্দুল আজিজকে আসামী হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়।
তার বাবা ২০১৩ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। হার্ট ব্লক হওয়ার পর থেকে ভারতীয় চিকিৎসকের পরামর্শে সুস্থ ছিলেন। বাবার কাগজ সে ঝাউডাঙা বাজারে বিলি করতো।
সাজু আরো জানান, তার বাবা পেশায় ছিলেন কৃষক। নিজেদের সামান্য জমি ও অন্যের জমি লীজ নিয়ে চাষাবাদ করতেন। তার বাবা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও গত বছরের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে স্থানীয় একটি গোষ্টির হুমকি- ধামকিতে ছিলেন। ফলে প্রকাশ্যে বের হতে পারতেন না। রাতে তাকে অন্যত্র থাকতে হতো। একপর্যায়ে কর্মহীন হয়ে পড়া বাবা তার ও তার বোন ঝাউডাঙা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সুমাইয়ার পড়াশুনার টাকা যোগান দেওয়ার পাশাপাশি নিজের ঔষধ কেনা ও সংসারের খরচ চালাতে পারতেন না। বাধ্য হয়ে অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কখনও কখনো এলাকায় পুলিশ আসার খবর পেয়ে কাজ ছেড়ে চলে যেতেন। এ নিয়ে চিন্তা করতে করতে তার দাদী মোমেনা খাতুন এক মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। নিজের অসুস্থতা ও সংসারের অসচ্ছলতার পাশাপাশি গ্রেপ্তার আতঙ্কে তার বাবা রাজনগর গ্রামের এক ব্যক্তির বোরো খেতে কাজ করার সময় শনিবার সকাল ৯টার দিকে মস্তিকে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মাটিতে পড়ে যান। তাকে দ্রুত সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরী বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ঘটনার সময় বিদেশ থাকা তাদের গ্রামের আব্দুল আজিজ মিথ্যা মামলার দায় মাথায় নিয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে পরিবার পরিজন ছেড়ে ঢাকায় কাটাচ্ছেন। এ ধরণের মিথ্যা মামলার যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে যাতে তার বাবার মত কাউকে অল্প বয়সে জীবন হারাতে না হয় সেজন্য প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাজু।
এদিকে মৃত মনিরুল ইসলাম মনির প্রথম জানাযা হাচিমপুর গ্রামের নিজ বাড়ির পাশে শনিবার দুপুর দুটোয় সম্পন্ন হয়। বিকেল সাড়ে চারটায় তার পৈতৃক ভিটা কলারোয়া উপজেলার কুশোডাঙায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে সে মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্যা গুণগ্রাহীকে রেখে গেছে। প্রথম জানাযায় সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ, সাংবাদিক এম জিল্লুর রহমান, দৈনিক পত্রদূতের মাষ্টার শহীদুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান মধু, সাংবাদিক মোমিনুর রহমান সবুজ ও মোস্তাক আহম্মেদ উপস্থিত ছিলেন।