বিসর্জন
শহরের একটা বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে ঈদের সকালটা যেন নীরব এক ঘড়ির কাঁটা।একটা সময় ছিল—ঈদের মানেই বাবার বাড়ি, উঠোনে ধুলো-মাখা দৌড়, গরুর গলায় ঝোলে সোনালি ঘন্টা, মা’র হাতে বানানো নরগিস কোফতা, ভাইদের ধাক্কাধাক্কি, আর বোনের মুগ্ধ চোখে শাড়ি পরার মহড়া।
আর এদিকে আমি?
আমি একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার ও সরকারি কর্মকর্তা।বছরজুড়ে সরকারি সেবা প্রদান আর সেবাগ্রহীতাদের মাঝে কাটে আমার দিন। আর ঈদের মত ছুটির দিনেও আমি কর্মস্থলে, রাষ্ট্রের জরুরি সেবাদানকারী দপ্তর হিসেবে বরাবরের মতোই ছুটি বাতিল তাই বাবা মায়ের কাছে ছুটির দিনেও যাওয়া হয়নি!মা ফোনে কাঁদলেন, বাবা নীরব থাকলেন। আমি বললাম—
“বাচ্চারা ছোট, কাজের চাপ, ছুটি বাতিল… বুঝতে পারো তো, বাবা!”পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে প্রিয়তা আর ইশান—আমার প্রাণ। ওদের সঙ্গেই এবার ঈদ।আর একটা ছোট ছাগল—কিনেছি প্রিয়তার আবদারে।
সকাল নয়টায় ঘুম ভেঙে দেখি প্রিয়তা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছাগলটার গলায় ফুলের মালা পরাচ্ছে।
বলল, “বাবা, ওর নাম রেখেছি ‘রঙিলা’। কোরবানি দিতে হবে তো, তাই সাজিয়ে দিচ্ছি।”ইশান পাশ থেকে চেঁচিয়ে বলে, “না! রঙিলারে কাটতে দিব না! ও আমার ফ্রেন্ড!”
আমি হেসে বলি,“এইটাই তো কোরবানি, ইশান। যাকে ভালবাসি, তাকেই সৃষ্টিকর্তার পথে উৎসর্গ করা।”প্রিয়তা তখন বলে বসে,“তাহলে তুমি তোমার মোবাইলটা দাও কোরবানি করে! তুমি সেটাকেই বেশি ভালোবাসো!”
আমি থমকে যাই।
ওদের ছোট ছোট কথার মাঝে যেন আমার সমস্ত অফিস-অহং, ক্লান্তি, ঈদের নিঃসঙ্গতা ধরা পড়ে যায় আয়নায়।ছাদে গিয়ে কোরবানির সময় আসে। আমি ছাগলটার চোখে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ।
কিছু একটা চেপে বসে বুকের ভেতর। যেন শুধু ছাগল না—আমি বিসর্জন দিচ্ছি আমার দোষ, অভিমান, অফিস-কেন্দ্রিকতা, আত্মকেন্দ্রিকতা।ছুরি চলে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
“রঙিলা” চলে যায়। থেকে যায় ঈদের আসল মানে।কর্মব্যস্ত কোরবানির কার্যক্রম এর পর ইশান ঘুমায়, প্রিয়তা ডায়েরিতে কিছু লিখছে।আমি পাশে বসে বলি,
“কি লিখছো মা?”সে বলে,
“আজ আমার বাবা কোরবানি দিয়েছে। ছাগলও, আর নিজেকেও একটু একটু।”আমি জিজ্ঞেস করি,
“কীভাবে বুঝলে?”ও বলে,“তুমি আজ অফিস করো নাই, আমাদের সঙ্গে হেসেছো, গল্প বলেছো… তুমিও বদলেছো।”ঈদের কোরবানি মানে শুধু পশু নয়, বরং সেই অহংকারকে বিসর্জন—যা আমাদের কাছের মানুষদের দূরে ঠেলে দেয়। ঈদ তো হৃদয়ের উৎসব, সেখানে ব্যস্ততা নয়, ভালোবাসাই বড় কোরবানি।
০৭ জুন, ২০২৫