সমাজ ও পরিবারের নানা বাঁধা কাটিয়ে জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করেছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৫ নারী। নানা বাঁধা বিপত্তিকে পায়ে মাড়িয়ে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব নারীদের খুঁজে বের করে ২০২৪-২৫ সনের জয়ীতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় ৫টি ক্যাটাগরীতে সম্মাননা দিয়েছে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। এ সকল নারীদের প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে অসীম আত্মশক্তি ও সংগ্রামের আলাদা আলাদা জীবন কাহিনী।
দেশের জনপ্রিয় অনলাইন বাংলা নিউজ পোর্টাল দেশ টাইমস deshtimes24,news এর নিজস্ব প্রতিবেদক গাজী জাহিদুর রহমানের নেওয়া সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠিয়ে নিয়ে এনেছেন তাদের সেই সংগ্রামী জীবনের কিছু তথ্য পাঠকদের তুলে ধরা হলো:
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী মোছাঃ আফরোজা খাতুন দেশ টাইমসকে বলেন, জীবন সংগ্রামে দারিদ্রতাকে পিছনে ফেলে সাফল্য অর্জন করেছেন মোছাঃ আফরোজা খাতুন। তার পিতা মোঃ সাজ্জাদ আলী একজন হৃতদরিদ্র কৃষক। কৃষিকাজের পাশাপাশি বাড়ির সাথে ছোট একটা মুদির দোকান ছিল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আফরোজা খাতুন সবার বড়। সন্তান লালন পালনে সীমাহীন কষ্ট হওয়ায় যাওয়ায় বড় কন্যা আফরোজা খাতুনকে দরিদ্র ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। দরিদ্র স্বামীর সংসারে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। রাজমিস্ত্রী স্বামীর একার পক্ষে তাদের সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। দুই ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করানোর জন্য সংসারের হাল ধরেন আফরোজা। বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্জি ও নকশিকাঁথার প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে ২০ হাজার টাকার ছিট-কাপড় উঠান তিনি। সেই কাপড় বিক্রির পাশাপাশি দর্জি ও নকশীকাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে সংসারের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করেন তিনি। কোন নারী মারা গেলে আফরোজা গোসল করানো কাজরে পাশাপাশি ধাত্রীর কাজ করেন। সর্বশেষ তিনি সাতক্ষীরার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের ১,২,৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার নির্বাচিত হয়ে জনসেবা করে যাচ্ছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে অনেক ভালো আছেন আফরোজা খাতুন।
শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী নাহিদাল আরজিন দেশ টাইমসকে বলেন, শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী নাহিদাল আরজিন। তিনি হাজারও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন আলোকবর্তীকা হয়ে। অল্প বয়সে পিতাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নাহিদাল বড়। দারিদ্রতা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিদিন ছয় কিলোমিটার পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেন। স্নাতক পাশ করার পর নাহিদাল ২০০১ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এরপরে তিনি এ কৃতিত্বের সাথে বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করেন। তথ্য প্রযুক্তিকে সঙ্গি করে পাঠদানে বিরল দৃষ্টান্ত দেখিয়ে চলেছেন নাহিদাল। ডিজিটাল কনটেন্ট মডেল তৈরি, পাঠদানের পাশাপাশি তিনি শিশুদের ছড়া, নাচ, গান, গল্প, অভিনয়, চারু ও কারুকলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শরীর চর্চায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। বৈশ্বিক মহামারিতে করোনাকালীন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ঘরে বসে শিখি অনলাইনে পাঠদানসহ সরকার ঘোষিত গুগলমিট ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদান অব্যাহত রাখেন তিনি। আইসিটি বিভাগে জেলা অ্যাম্বাসেডর হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন নাহিদাল আরজিন। এছাড়া তিনি মাইক্রোসফট ইনোভেশন এডুকেটর, ওয়েকলেট অ্যাম্বাসেডর, কাহুট সহ বিভিন্ন বিশ্বমানের ব্লেন্ডেড লার্নিংয়ে নিজেকে এবং বিদ্যালয়ের শিশুদের সমৃদ্ধ করছেন প্রতিনিয়ত। কাব ইউনিট লিডার হিসেবে নিজের বিদ্যালয়ের শিশুদের কাব স্কাউটে দক্ষ করে গড়ে তুলছেন। চারু ও কারুকলার মাষ্টার ট্রেনার হিসেবে বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের বিভিন্ন হাতের কাজে পারদর্শী করে তুলছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখালেখি প্রকাশিত হয়। শিশুদের নিয়ে তার প্রথম লেখা বই ‘অংকুশ’। এছাড়া ছোটদের ‘কম্পিউটার শিখি’ নামের বইয়ের প্রকাশনার কাজ চলমান রয়েছে।শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য নাহিদাল আরজিন সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হিসেবে নির্বাচিত হন। সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করেছেন এবং নিজেকে সফল-আলোকিত মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নাহিদাল আরজিন।
সফল জননী অর্জনকারী নারী মমতাজ খাতুন দেশ টাইমসকে বলেন, সফল জননী নারী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মমতাজ খাতুন। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সকলের বড়। অভাব অনাটনের মধ্যে বড় হওয়া মমতাজের ছোট বেলা থেকে খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ ছিল। নানা প্রতিকূলতার কারণে তার খেলাধূলা স্কুল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৪ সালে বিএ পাশ করার পর শুরু হল তার বিবাহিত জীবন। তার দুই মেয়ে আফরা খন্দকার ও আফঈদা খন্দকার। ছোট বেলা থেকে তার ইচ্ছা ছিল মেয়েদের খেলাধূলায় পরদর্শি করে গড়ে তুলবে। তখন থেকে তিনি এবং তার স্বামী দুজনেই মিলে মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি লেখাধূলা চর্চা শুরু করেন। একপর্যায়ে ছোট মেয়ে ২০১৬ সালে বি.কে.এস.পি তে মেয়েদের ফুটবল বিভাগে ভর্তি করি। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট সুব্রত মুর্খাজী কাপে অংশগ্রহণ করে এবং ২০১৯ সালে শ্রেষ্ঠ খেলোয়ার হিসেবে নির্বাচিত হয়। একই সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলে অনুর্ধ ১৫ ভূটানে অনুষ্ঠিত সাফ চাম্পিয়ন শীপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যুব গেমসে ফুটবল বিভাগে অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ২০২১ সালে সাফ অনুর্ধ ১৯ চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক হওয়ার গৌরব অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতাসহ পদক গ্রহণ করে সে। তার বড় কন্যা আফরা খন্দকার ২০১৬ সালে বিজয় দিবস বক্সিংয়ে ব্রোঞ্জস পদক অর্জন করে। ২০১৭ সালে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা কাপে সিলভার পদক অর্জন করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যুব গেমসে ৪৬কেজি ওজন শ্রেণিতে সাতক্ষীরা জেলার পক্ষ হতে গোল্ড পদক অর্জন করে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে জাতীয় জুনিয়র মহিলা বক্সিংয়ে স্বর্ণ পদক অর্জন করে। ২০২১ সালে মহিলা বক্সিং চ্যাম্পিয়ন শীপে সিলভার পদক অর্জন করায় তাকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন সংগঠন তাকে সংবর্ধনা দেয়। সর্বশেষ প্রফেশনাল বক্সিং চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তার দুই কন্যার জন্য দেশ ও জাতির গৌরবের শ্রেষ্ঠ স্থানে উঠাতে পেরে তিনি গর্বিত। এদিকে ২০১৬ সাল থেকে তাদের নিজ বাড়িতে হিন্দু, বোদ্ধ, খ্রিষ্টান ও মুন্ডা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ছিন্নমূল ও গরীব অসহায় মেয়েদেরকে নিয়ে বিনা খরচে, বিনা পারিশ্রমিকে ফুটবলসহ বিভিন্ন বিভিন্ন খেলায় পরদর্শি করে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বি.কে.এস.পি ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে অংশগ্রহণ করে আসছে। এই সকল মেয়েদের খরচ চালানোর জন্য তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী নিয়ে তার সামান্য বেতনের অর্থ দিয়ে তাদের যাবতীয় খরচ চালিয়ে আসছেন। তাদের এই খেলাধূলা শেখানোর জন্য বিভিন্ন সমালোচনা উপেক্ষা করে সহযোগিতা করে আসছেন তিনি।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন মোছাঃ নুরুন্নাহার বেগম দেশ টাইমসকে বলেন, একজন নারী হয়েও জীবন সংগ্রামের মাঝে সমাজের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন মোছাঃ নুরুন্নাহার বেগম। তিনি সাতক্ষীরার ব্রহ্মরাজপুর গ্রামের মৃতঃ শেখ এবাদুল্লাহ’র কন্যা এবং মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী। নিম্নবিত্ত পরিবার থাকে উঠে আসা একজন নারী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য তিনি। পেশাগতভাবে তিনি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী এবং পল্লী চিকিৎসক। ১৯৮২ সালে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানের সাথে। বিবাহের পর থেকে যৌতুকের জন্য পোহাতে হয় নানা বঞ্চনা এবং নির্যাতন। এক পর্যায়ে তিনি পল্লী চিকিৎসক কোর্সে করেন। সেখান থেকে প্রাকটিস শুরু করার পাশাপাশি স্বামীর সহযোগিতায় ধাত্রী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পাড়া-মহাল্লায় গর্ভবতি নারীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ধীরে ধীরে তিনি স্বনির্ভর হন এবং কিছু আবাদি জমি ক্রয় করেন। ১৯৯৬ সালে ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি একটি এনজিও’র সহোযোগিতায় নিজ এলাকার বয়স্ক নারীদের অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভের পর জনগণের সেবাদানের জন্য ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে মাত্র ৩ ভোটের ব্যাবধানে পরাজিত হন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৬ এবং ২০২১ সালে পরপর দুইবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন তিনি। অদ্যাবধি নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নব উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী জুলেখা খাতুন দেশ টাইমসকে বলেন, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নব উদ্যমে জীবন শুরু করা সংগ্রামী নারী জুলেখা খাতুন। তিনি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর গ্রামের অজেত আলী গাজীর কন্যা। ছোট বেলা থেকে অভাব অনাটনে মানুষ জুলেখা খাতুন। বিয়ের পর থেকে স্বামীর ও তার স্বজনদের কাছ থেকে নির্যাতিত হন তিনি। এক পর্যায়ে স্বামীর সংসার করা হয়নি তার। চলে আসে বাবার বাড়ি। সেখানে সেলাইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করে জীবন নির্বাহ করছেন তিনি। বর্তমানে সুখেই আছেন জুলেখা খাতুন।