দেশের জনপ্রিয় বাংলা অনলাইন নিউজ পোর্টাল দেশ টাইমস ২৪ নিউজ deshtimes24.news এর সাহিত্য সম্পাদক কবি তানভীর আহমেদ এর প্রিয় বন্ধুর মহামূল্যবান উপহার লেখাটি দেশ টাইমস এর প্রিয় পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
প্রায় এক যুগ পর দেখা এক বন্ধু আমাকে জর্জ অরওয়েলের “১৯৮৪” এবং “এনিমেল ফার্ম” বই দুটির অরিজিনাল প্রিন্ট উপহার দিলো! টানা দুই রাত পড়ে যা বুঝলাম তা মাথা থেকে বের হচ্ছে না!এনিমেল ফার্ম টা আগে শেষ করলাম , ১৯৮৪ টা শুক্র শনির জন্য রেখে দিয়েছি!
“All animals are equal, but some animals are more equal than others”—এই বিখ্যাত বাক্যটি দেখায়, কীভাবে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থে আদর্শকে বিকৃত করে। জর্জ অরওয়েলের রচিত “এনিমেল ফার্ম” একটি রাজনৈতিক রূপকধর্মী উপন্যাস, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। বইটি মূলত সমাজতন্ত্রের আদর্শ, বিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহারকে চিত্রিত করে। এটি রাশিয়ার ১৯১৭ সালের বিপ্লব এবং তার পরবর্তী স্তালিনীয় যুগের প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ।
বইটি গভীরভাবে পাঠ করে যা সারবস্তু আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আসে তা এরুপ;
“এনিমেল ফার্ম” একটি খামারের গল্প, যেখানে পশুরা মানুষ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং খামারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়। তারা একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করে, যেখানে সব পশু সমান হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে নেতারা (বিশেষ করে শূকররা) ক্ষমতার স্বাদ পায় এবং মানব শাসকদের চেয়েও বেশি নিপীড়ক হয়ে ওঠে।
পয়েন্ট আকারে মূল বিষয়বস্তু:
১.স্বাধীনতা ও সমতা: বইটি প্রথমে একটি আদর্শ সমাজের স্বপ্ন তুলে ধরে, যেখানে সব পশু সমান এবং শোষণমুক্ত জীবনযাপন করবে। তবে এই সমতা অল্প সময়েই ভেঙে যায়।
২.ক্ষমতার অপব্যবহার: শূকর নেপোলিয়ন ধীরে ধীরে পুরো খামারের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তার শাসন প্রমাণ করে, কিভাবে ক্ষমতা অর্জনের পরে নীতিমালা পরিবর্তিত হয় এবং শাসকেরা নিজেদের স্বার্থে সাধারণ জনগণকে শোষণ করে।
৩.প্রচার এবং মিথ্যাচার: শূকর স্কুইলার খামারের পশুদের বিভ্রান্ত করতে মিথ্যা তথ্য এবং প্রচার ব্যবহার করে। এটি দেখায় কিভাবে প্রোপাগান্ডা ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণকে বশে রাখা যায়।
৪.বিপ্লবের ব্যর্থতা: পশুদের বিদ্রোহ, যা একসময় ন্যায়বিচারের প্রতীক ছিল, তা ধীরে ধীরে একটি নতুন ধরনের শোষণে রূপান্তরিত হয়। বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়।
৫.মানব প্রকৃতি এবং শাসনব্যবস্থা: বইটি শেষ হয় এই বার্তা দিয়ে যে, ক্ষমতা মানুষের (বা যে কোনো শাসকের) চরিত্রকে পরিবর্তন করে এবং অবশেষে শোষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
৬.ক্ষমতা দুর্নীতি আনে: বইটি দেখায়, যে নেতারা সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে, তারাই ধীরে ধীরে শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
৭.সাধারণ জনগণের বঞ্চনা: সাধারণ জনগণ (যেমন, বইয়ের বাক্সার নামক ঘোড়া) কঠোর পরিশ্রম করেও তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং নেতাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়।
৮.অবচেতন জনগণ: যদি জনগণ সচেতন না হয় বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ না তোলে, তবে তারা চিরকাল শোষিত হবে।
এই বইয়ে লেখক ইউজ করেছেন কিছু প্রতীকী উপমা:
• পশুরা: সাধারণ মানুষ, যারা শাসনব্যবস্থার শিকার।
• নেপোলিয়ন: জোসেফ স্তালিনের প্রতীক।
• স্নোবল: লিয়ন ট্রটস্কির প্রতীক।
• ম্যানর ফার্ম: রাশিয়ার সামন্ততান্ত্রিক সমাজ।
• মি. জোন্স: জারশাসিত রাশিয়া।
• নতুন শাসনব্যবস্থা: স্তালিনের নেতৃত্বে গড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আমি উপসংহার হিসেবে যা দেখলাম তা এককথায় বর্ণনা করলে হয় যে,
“এনিমেল ফার্ম” একটি চিরন্তন শিক্ষা দেয় যে, ক্ষমতা এবং রাজনীতির অপব্যবহার সবসময়ই সাধারণ মানুষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি কেবল রাশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমি নয়, বরং যেকোনো সমাজ ও সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। অতএব, “এনিমেল ফার্ম” কেবল একটি সাহিত্যকর্ম নয়, বরং এটি সমাজের রাজনীতি, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জনগণের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে হলে কেবল বিপ্লব যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ন্যায়পরায়ণ, নৈতিক ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব। অরওয়েল এই বইয়ের মাধ্যমে সতর্ক করেছেন, বিপ্লব যতই মহৎ উদ্দেশ্যে শুরু হোক, যদি তা সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে তা নতুন শোষণের জন্ম দেয় এবং বিপ্লবের প্রাথমিক উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং নৈতিক নেতৃত্বের অভাবে তা কেবল শাসকশ্রেণির ক্ষমতা জোরদার করার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।