মৌসুমি বন্যায় এবছর ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নিম্নাঞ্চল আবারও আকাশ বন্যায় তলিয়ে গেছে। মাস দুয়েক আগে বেতনার বাঁধ ভেঙে আর আকাশ বন্যায় ডুবে যায় তালা উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তারপর থেকে রোদে শুকিয়ে যেটুকু পানি কমতো পরের দিন তার দ্বিগুণ বাড়তো। এভাবে ডুবতে ডুবতে ভেসেছিল তালা উপজেলার মানুষ। কিন্তু বুধবার থেকে ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে কার্তিকের আকাশ থেকে অঝর ধারায় ঝরতে থাকে শ্রাবণীধারা। এতে আবারও তলিয়ে যায় তালা উপজেলার নিম্নাঞ্চল।
এতে তালা উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মানুষ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দফায় দফায় বর্ষণে মৎস্যঘের, আউশ ধান ক্ষেত, সবজির ক্ষেতে তলিয়ে সকল প্রকারের কৃষি ফসল নষ্ট হয়েছে। সবজি ও চালের বাজার অস্থির। দ্রব্যমূল্য নিয়ে শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। আউশ ধান হয়নি, সামনে বোরোধান না হওয়ার আশংকা। কাঁচা রাস্তা ও আধা পাকা রাস্তা, পিচের রাস্তার উপর কতকাংশ পানিতে ডুবে গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেঁতুলিয়া, খেশরা ও খলিশখালী ইউনিয়নের মানুষ ও প্রাণীকূল। মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে ঘের মালিকদের ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ’ কোটি টাকার সম্পদ। পানি কমতে না কমতে আবারও তেঁতুলিয়া ইউনিয়নসহ ২৩০টি গ্রামের মধ্যে অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
সরেজমিনে শুক্রবার (২৫ অক্টোবর ‘২৪) সকালে গিয়ে দেখা যায়, তালা উপজেলা তেঁতুলিয়া, খেশরা, খলিশখালী, নগরঘাটা ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সকল ইউনিয়নে ধান ও সবজি পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জীবন খুব সংকটময় পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছে। সাধারণ মানুষের আশঙ্কা অবধারিত খাদ্য সংকটে আগামীর তালা উপজেলা। দিনমজুর কৃষকরা কাজ না পেয়ে অতিকষ্টে দিনযাপন করছেন।
এদিকে ধারাবাহিক বৃষ্টিতে বেসরকারী হিসাবে প্রায় ১ থেকে ২ হাজার মৎস্য ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। তাতে ৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আন্দাজ করে জানিয়েছেন ঘের মালিকরা। এমনকি উপজেলা ৩-৪ ইউনিয়ন জুড়ে প্রায় শতাধিক পোল্ট্রি খামার পানিতে তলিয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খামারী শিরিনা বেগমসহ একাধিক খামারী।
অপরদিকে মসজিদ, মন্দির গীর্জাসহ সকল ধরণের একাধিক ধর্মীয় উপাসনালয়ে পানি উঠেছে। ব্যাহত হচ্ছে ইউনিয়নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান। চরম বিপাকে পড়েছেন এই জনপদের মানুষ। এলাকাজুড়ে পানি থাকায় স্যানেটারি ব্যবস্থায় পড়েছে বিরুপ প্রভাব। এতেকরে সুপ্রিয় পানির অভাবের পাশাপাশি, চর্ম রোগ, পানিবাহিত রোগ,ডায়রিয়া জনিত রোগে বেড়ে গেছে।
তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এই ইউনিয়নটি ১৭টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। আর পানিতে প্লাবিত হয়েছে ১৭টি গ্রামই। কৃষকদের ফসল পানির নিচে থাকায় পচন ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে টানা বর্ষণের ফলে তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের মধ্যে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিরাশুনী, লাউতাড়া, পাঁচরোখি, সুভাশিনী, মদনপুর, সুমজদিপুর, দেওয়ানীপাড়া গ্রাম। সকল এলাকার ধানও সবজি পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জীবন খুব সংকটময় পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছে। আগামীতে অবধারিত খাদ্য সংকটে পড়বে তেঁতুলিয়া ইউনিয়নসহ তালা উপজেলা। এতেকরে মারাত্নক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে কৃষক ও প্রাণীকুল।
পাঁচরোখি গ্রামে শেখ আব্দুস ছাত্তার, মদনপুর গ্রামের আব্দুল খালেক, সুমজদিপুর গ্রামের সুবাসী দাশ, শিরাশুনী গ্রামের মোমিন শেখ, আসমা বেগমসহ কয়েকজন তৃতীয় মাত্রাকে জানান, তারা প্রায় দুই মাস পানিবন্ধি। তাদের বাথরুমে যাওয়া, রান্না করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। একইসাথে চারিদিকে পানি থাকায় মারাত্মকভাবে বিষধর সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্য কয়েকটি পদ্মগোখরা সাপ পিটিয়ে মারা হয়েছে।
তেঁতুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ দেশ টাইমসকে বলেন, এই এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য সাধারণত যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদী দিয়ে পানি সরবরাহ করতো। বর্তমানে ঐ এলাকার নরনিয়া স্লুইস গেট পলিমাটিতে উঁচু হয়ে পানি নিষ্কাশনে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে গ্রামঞ্চলের রাস্তা, বাড়ি-ঘর,মৎস্য ঘের প্লাবিত হচ্ছে। খাল ও নদীর তলদেশ বর্তমানে নরনিয়া খালের স্লুইস গেটের উপর চার পাঁচ ফুট পানি রয়েছে।
তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মো. রাসেল দেশ টাইমসকে জানান, তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের পানি নিষ্কাশনের জন্য যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার নরনিয়া স্লুইস গেট এলাকায় পলি মাটি অপসারণের জন্য ৩/৪টি স্কেভেটর দিয়ে কাজ চলমান আছে। তবে এর স্থায়ী সমাধানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রকল্প গ্রহণ করে নরনিয়া খাল, ভদ্রা নদী প্রশস্ত করে পুনঃখনন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আশু পানি নামাতে বিকল্প পথ হিসেবে দধিসারা বিল দিয়ে শালতা নদীতে পানি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।