সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবের ফলে অতিবৃষ্টি ও বেতনা নদীর ভেঙে যাওয়া বেড়িবঁাধ সংস্কার না হওয়ায় সাতক্ষীরা পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ড, সদরের ১০টি ইউনিয়ন ও তালা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মোট ৬০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ছয় হাজার মাছের ঘের, দেড়হাজার পুকুর ও কাঁকড়ার হ্যাচারী ছাড়াও আমন ধান ও শাকসবজীর খেত ভেসে গেছে। পানিবন্ধি হয়ে পড়েছে ১০ হাজারের বেশি পরিবার। বুধবার বিকেল থেকে আবারো টানা বৃষ্টিতে নতুন করে পানি বাড়তে শুরু করেছে। জমা পানি বিষাক্ত হয়ে পানিবাগিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। বাড়ছে জনদুর্ভোগ। মৎস্য ও কৃষি খাতে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জেলা মৎস্য অধিদপ্তর।
সাতক্ষীরার আবহাওয়া অফিস জানায়, গত সপ্তাহের শনি থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত চার দিনে ৯৬ ঘণ্টায় ২৫৬ মিলিমিটার ও গত বুধবার ভোর থেকে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের লিলি চক্রবর্তী, সন্তোষ দাস ও তালা উপজেলার আহসাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রুকসানা পারভিন জানান, গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনে ৯৬ ঘণ্টায় ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় সাতক্ষীরা জেলায়। ভারী বর্ষণের কারণে ১৫ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকার শ্মশানঘাটের পাশের বেতনা নদীর পাউবোর রিংবাঁধ ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। এ ছাড়া বুধবার ভোর থেকে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত নতুন করে টানা বৃষ্টিতে এলাকায় পানি বেড়েছে। বৃহষ্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৪টা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মাদ্রা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সন্দীপ মণ্ডল জানান, অতি বৃষ্টি ও বাঁধ ভেঙে তালা উপজেলার মাগুরা, নগরঘাটা, খলিশখালি ইউনিয়নের আটুলিয়া থেকে মাগুরা বাজার সড়ক, মাদ্রা থেকে বালিয়াদহ, কলাগাছি থেকে মুড়াগাছা সড়ক ছাড়াও আহসাননগর হরিণখোলাসহ কয়েকটি গ্রামের ইটের সোলিং রাস্তাসহ বেশ কয়েকটি রাস্তা তলিয়ে গেছে। উপজেলার বিনেরপোতা, আহসাননগর, হরিণখোলা, গাছা, দক্ষিণ নগরঘাটা, হাজরাতলা, পালপাড়া, গাবতলা, দোলুয়া, নগরঘাটা, রথখোলা, কাপাসডাঙ্গা, মাদ্রা গুচ্ছগ্রাম, নিমতলাসহ কমপক্ষে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ সদর উপজেলার মধ্যকার ছাকার মোড় থেকে শাল্ল্যে বাজার, তালতলা থেকে গোপীনাথপুর ডেইয়ের বিল, মাঠপাড়া থেকে গদাই বিল, শহরের রথখোলা সড়ক, কামানগর, মধুমোল্লারডাঙিসহ সদরের বেশ কয়েকটি রাস্তা পানির তলায়। ওইসব রাস্তা দিয়ে গাড়ি তো দূরের কথা, মানুষ চলাচল করতে পারেছ না। এ ছাড়া সদর উপজেলার পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার ঘুটেরডাঙ্গী, রামচন্দ্রপুর, লবণগোলা, পাথরঘাটা, দামারপোতা, জিয়ালা, ধুলিহর, বালুইগাছ, ফিংড়ি, ফয়জুল্লাহপুর, দরবেশতিয়া, কোমরপুর, তেঁতুলডাঙ্গী, মাছখোলা, খেজুরডাঙ্গা, গোপীনাথপুর, গোয়ালপোতা, তালতলা, শ্যালেসহ ৪০টি গ্রাম ও পৌর এলাকার অর্ধেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ২০-২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ওই এলাকাসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকার মাছ ও কাঁকড়ার ঘের তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে পুকুর, আমন ধান ও শাক-সবজির খেত।
সদর উপজেলার তালতলা গ্রামের ঘের ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান বলেন, আমার ৩টি ঘের রয়েছে ১২০ বিঘা জমির ওপর। সবকটায় চাষ করা হয়েছিল সাদামাছ। বৃষ্টিতে সবগুলো ঘের তলিয়ে রয়েছে। সবমিলিয়ে আমার প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আগরদাড়ি ইউনিয়নের কৃষক মো: আজহারুল ইসলাম বলেন, আমি ৮ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছি, তার মধ্যে ৬ বিঘা পানিতে তলিয়ে গেছে, ৮ বিঘা জমিতে আমার প্রায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। বৃষ্টির পানি বেড়ে পুরো ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ধান গাছগুলো পানির নিচে পঁচে গেছে। এভাবে বৃষ্টি হতে থাকলে গাছগুলো সব মারা যাবে।
মাছখোলা গ্রামের আমিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে তাদের এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার রুপ নিয়েছে। সুপেয় পানির অভাবে দুষিত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ঘাস, সবজি খেত, মরা গবাদিপশুসহ পচনশীল দ্রব্য পানিতে মিশে দুর্গন্ধ হওয়ার পাশপাশি শিশু থেকে বৃদ্ধরা চুলকনা, পঁাচড়া, সিিদ্দি, কাশি, জ্বর, আমাশয়, ডায়েরিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। রাস্তা পানিবন্ধি থাকার ফলে আক্রান্তদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা স্কুল- কলেজে যেতে পারছে না।
তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের নির্মল মণ্ডল জানান, তার সতের বিঘার একটি মাছের ঘের রয়েছে। তাতে এক লাখ টাকার রুই, কাতলা ও মৃগেলসহ নানা জাতের মাছ ছেড়েছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ভেসে গেছে ওই ঘের। এখন তার মাথায় হাত। নেট পাটা দিয়ে কিছু মাছ রাখার চেষ্টা করলেও নতুন করে বুধবার থেকে বৃষ্টি হওয়ায় সে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃহষ্পতিবার সকাল ১১টায় সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে এক নাগরিক সংলাপে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীতে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো, সাতক্ষীরা পৌরসভাকে পুরোপুরি ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রাণসায়ের খালের দুই মুখ উন্মুক্ত করে স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো, আন্তঃনদী সংযোগ বিশেষ করে ইছামতি, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, বেতনা, শালিখা ও কপোতাক্ষকে খননের আওতায় এনে চিরায়ত নিয়মে পানিপ্রবাহ সচলকরণ, নদীগুলোর সাথে সংযুক্ত খালগুলো পুনঃখনন করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, অকেজো হয়ে পড়ে থাকা স্লুইসগেটগুলো সংস্কারকরণ, পৌর এলাকার মধ্যে মৎস্য ঘের নিষিদ্ধকরণ, নদীগুলো খননের সঙ্গে সঙ্গে সংলগ্ন বেড়িবাঁধগুলোও টেকসই করে বেড়িবাঁধ বাঙন রোধ, বেড়িবাঁধে বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ, নদী ও খালের প্রবাহ বিঘ্নিত হয় এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করা, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগেই পানি নিষ্কাশনের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিরুপণের মাধ্যমে জলবায়ু ফান্ডের অর্থ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, চলতি আমন মৌসুমে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পাঁচ হাজার ৪৫২ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৪৯ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চলতি আমন মৌসুমে মাঠের শাকসবজি সহ ৯৮ হাজার ৭৮৩ হেক্টর জমির লাগানো ধানের মধ্যে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ৫ হাজার ৪৫২ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৪৯ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার বাজার মূল্য ৯ কোটির উর্ধে। এখানে কৃষক সংখ্যা রয়েছে ৫ হাজার ৩৫০ এর মতো।
তিনি আরও বলেন, এখন আমরা এই বৃষ্টির পানিতে সৃষ্টি হওয়া জলবদ্ধতা যদি নিরসন করতে পারি, তাহলে সেসব যায়গায় আবার কৃষকদের পুনর্বাসিত করে এবং আমাদের পরামর্শ দিয়ে তাদেরকে আবার শাকসবজি ও আগাম খাদ্যশস্য আবাদের দিকে অগ্রসর হতে পারবো। আশা করছি আবার সাতক্ষীরা জেলা ফসল উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অনুযাযায়ী এগিয়ে যেতে পারবো। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার মো: আনিছুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় গত কয়েক দিন যাবত অতিবৃষ্টিজনিত কারণে সাতক্ষীরা সদরের বেতনা নদীর একটা অংশ ভেঙে যাওয়ার কারণে তার আশপাশের ঘেরগুলো একেবারে পানির সাথে মিশে গেছে। এখানে আমাদের মোট ৫ হাজার ২৩০ হেক্টর এরিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে অধিকাংশ মাছ, এবং এতে মৎস্য চাষীদের ৬০০ কোটি টাকার অধিক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে সেটিও ৪ কোটি টাকার অধিক। এ ক্ষতির হাত থেকে চাষীদের রক্ষা করতে সহজ শর্তে যদি ঋণের ব্যবস্থা করা যেত, অথবা তাদের প্রণোদনার আওতায় আনা গেলে চাষিরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।