বৈশাখের মধ্য গগণে সূর্যের তেজ ফুটছিল সেদিন। কৃষ্ণচূড়ার আগুন লেগেছিল যেন নগরে। রাজশাহী জেলের জানালা দিয়ে এগিয়ে আসা কৃষ্ণচূড়ার আগুন রাঙা ডাল দেখবে সমস্ত কক্ষ, আকাশে বাতাসে তার রঙ । কে জানত ধূসর মাখা এক বিকেলে নামবে লাশের মিছিল। শ্রাবণের অঝোর বর্ষণের মতো ঝরবে রক্ত। রাজশাহী জেলের ভিতরে আরেক জেল যেন খাপড়া ওয়ার্ড। টালির ছাদ, চারপাশে দেওয়াল।
উপমহাদেশের প্রথম জেলহত্যা খাপড়া ওয়ার্ড জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার (২৪ এপ্রিল) রাত ৮ টায় ৭১’র বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির আয়োজনে জেলা বাসদের কার্যালয়ে উক্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
একাত্তরের বধ্যবূমি স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সুভাষ সরকারের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব কমরেড ফাহিমুল হক কিসলুর পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার কল্যান ব্যানার্জি, জেলা জাসদের সহ সভাপতি অধ্যক্ষ আশেক -ই-এলাহী, জেলা বাসদের সমন্বয়ক কমরেড নিত্যানন্দ সরকার, কমরেড রওনক বাশার, তরুণ আইনজীবী এসএম ইকবাল লোদী, জেলা জাসদের সহ সম্পাদক কবি রুবেল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সভায় বক্তারা কারা অভ্যন্তরে নির্মমভাবে বিপ্লবীদের হত্যা করার জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন। পাশাপার্শি প্রতি বছর ২৪ এপ্রিল সরকারীভাবে খাপড়া ওয়ার্ড হত্যা দিবস পালনের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।
আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক আলি হোসেন, পৌর বাজাসদের সভাপতি আশরাফ সরদার, আশাশুনি উপজেলা ছাত্রলীগ(জাসদ) সভাপতি মফিজুল ইসলাম, কালিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ(জাসদ)’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইমরুল হাসান তুহিন প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল ভোরের দিকে বন্দীরা কিছু সময় ঘুমিয়ে ও নাস্তার খাওয়ার পর সকাল ৯টায় ফের আলোচনা শুরু করেন। ওই সময় জেল সুপার ডবি¬উ এফ বিল ওয়ার্ডের ভেতর ঢুকে বন্দীদের আবারও ১৪ নম্বর সেলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। জেল সুপার উত্তেজিত হয়ে ওয়ার্ডের দরজা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তার পথরোধ করে দাঁড়ান বাবর আলী, দেলোয়ার ও রশিদ উদ্দিন। বিলের হান্টারের আঘাতে বাবর আলীর কব্জি ভেঙে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হুইসেল বাজান। সঙ্গে সঙ্গে ৪০ জন কারারক্ষী খাপড়া ওয়ার্ড ঘিরে ফেলে।
ওয়ার্ডের ভেতর কমিউনিস্ট বন্দীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন, দরজা আটকে রাখতে হবে। তারা নারিকেলের ছোবড়া, চৌকি, তোশক বালিশ ও শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা আটকে রাখেন। প্রসাদ রায় ছুটে গিয়ে দরজায় কাঁধ লাগান। বাইরে থেকে পুলিশ ধাক্কা দিতে থাকলে দরজা না খোলায় পুলিশ গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ প্রসাদ রায় মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েন। বেপরোয়া পুলিশ ঢুকে পড়ে ওয়ার্ডের ভেতরে। রাইফেলের গুলির শব্দ আর অসহায় বন্দীদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে কারাগারের বাতাস।
খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তারা পুলিশের লাঠির আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো কারাগারে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ছয় জন। আহত হন ওয়ার্ডের সবাই। খাপড়া ওয়ার্ডে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিক নেতা হানিফ শেখ। চারপাশের নিস্তব্ধতা দেখে যখনই খুলনার ছাত্র নেতা আনোয়ার মাথা তোলেন ঠিক তখনই একটি গুলি এসে লাগে তার মাথায়। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। তার মাথার খুলি উড়ে গিয়ে পড়ে পাশে নারকেলের ছোবড়ার মধ্যে।
পরিস্থিতি পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ওয়ার্ডের ভেতর ঢোকেন জেল সুপার বিল। খুঁজে বের করেন রাজবন্দীদের নেতা আবদুল হককে। তাকে পেয়ে বিল রাগে দিশাহারা হয়ে হান্টারের শক্ত অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। রক্তাক্ত আবদুল হক মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। এই দৃশ্য দেখে গুলিবিদ্ধ রাজশাহীর বিজন সেন চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমরা মরিনি কমরেড! আমরা জিতব। আগামী দিন আমাদের।’ এর পরই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাকিরা।
কেবলগুলিবর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ ও কারারক্ষীরা। আরেকদল পুলিশ এসে অতর্কিত লাঠিচার্জ শুরু করে আহত বন্দীদের উপর। এক বন্দী তখন তীব্র তৃষ্ণায় পানি পান করতে চাইলেন জেলার মান্নান সিপাহীকে নির্দেশ দিলেন সে বন্দীর মুখে প্রস্রাব করতে।
এর মধ্যে কারাগারের বাইরে থেকে রাজশাহীর পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টকে খবর দেওয়া হয়েছিল যে রাজবন্দীরা জেলগেট ভেঙে পালাচ্ছে। তিনি কারাগারে এসে দেখেন পুরোটাই মিথ্যা এবং সাজানো। রক্তাক্ত খাপড়া ওয়ার্ড দেখে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জেলার ও জেল সুপারকে গালাগাল করতে করতে পুলিশ নিয়ে চলে যান।
সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সাত জন কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী। আহত হয়েছিলেন ৩২ জন।