“যা রে যারে উড়ে যারে পাখি, ফুরাল গানের মেলা, শেষ হয়ে এলো বেলা, আর কেন তোরে মিছে বেঁধে রাখি”। সুরের মুর্ছনায় হাওয়ার তরঙ্গ ওঠে। পাখির গানের রাজ্যে নতুন সুরের ব্যঞ্জনা এনে দেয়। হৃদয়ে বিঁধে যায় সুর বন্ধনার তীঁর। গানের পাখি সুতপা মণ্ডলের এই অনবদ্য পরিবেশনায় হৃদয়ে কাঁপন তোলে। ভেসে যায় দূর থেকে দূরান্তরে।
শ্যামল ছায়াতলে পাখি ডাকা সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা সদরের কোদণ্ডা গ্রামে গেলে রোদেলা দুপুরে সুতপার গান যেন প্রকৃতিতে নতুন জীবন এনে দেয়। অজ পাড়া গাঁয়ের এই তরুনী শিল্পী এখন গান দিয়েই মাতিয়ে রেখেছে তার স্কুল, পরিবার ও গ্রামকে। সঙ্গীতজ্ঞ ও শিক্ষক বাবার মেয়ে হিসেবে একদিকে যেমন লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে চায় ঠিক তার পাশাপাশি সঙ্গীত জগতে তার বাল্যকালিন প্রবেশকে আরো বেশি করে সুসংহত করে সঙ্গীত প্রিয় মানুষের হৃদয়কে জয় করতে চায় সে। আর তাই মাঝে মাঝে কখনো স্কুলের শ্রেণী কক্ষে, স্কুলের মঞ্চে, প্রতিযোগিতার মঞ্চে, বাড়ির উঠানে, গ্রামীন অনুষ্ঠানে নিজেকে জানান দিতে চায় সুতপা মণ্ডল।
সাতক্ষীরা জেলার দুর্যোগ কবলিত আশাশুনি উপজেলা সদর ইউনিয়নের আধুনিকতার ছোঁয়া বঞ্চিত কোদণ্ডা গ্রামের দক্ষিণপাড়ার মাদ্রাসা শিক্ষক মৃণাল মণ্ডলের মেয়ে ও কোদণ্ডা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী মোবাইলে গান শুনে নিজে গুনগুন করে গান করার মাধ্যমে তার গানের জগতে প্রবেশ। আধুনিক প্রযুক্তি বঞ্চিত গ্রাম কোদণ্ডা দক্ষিণ পাড়ায় এখনো কোন টেলিভিশন ডিস লাইন পৌঁছায়নি। সঙ্গীত জগতে অপূর্ণ থাকা বাবা মৃণাল মণ্ডলের কাছে হাতে খড়ি সুতপার। এলাকায় সঙ্গীত একাডমেী না থাকলেও সুতপাকে ক্লাসিকাল গানের শিক্ষক আব্দুল মান্নান ও পরে সুখেন্দু সরকারের কাছে গান শেখাচ্ছেন বাবা। বাবার সঙ্গীত জীবনের অপূর্ণতাই তার মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চায় জানিয়ে সুতপা বলে,মানদাতা আমলের বাবার ব্যবহৃত হারমোনিয়াম দিয়েই তার গানের চর্চা শুরু ও এখনো সেই হারমনিয়ামই তার একমাত্র সম্বল।
এরই মধ্যে তার হৃদয় কাঁপানো সঙ্গীত পরিবেশনে মুগ্ধ হয়ে সুতপার হাতে এসেছে বিভিন্ন প্রকারের পুরষ্কার। গ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে শেখ রাসেলের জন্ম দিনে বাংলাদেশ চিন মৈত্রী মিলনায়তনে গণসঙ্গীতে নেতৃত্বে দিয়ে কৃতিত্ব লাভ করেছে সুতপা।
প্রয়াত কণ্ঠ শিল্পী লতা মুঙ্গেশকরের গানই সে বেশি পছন্দ করে। এ ছাড়াও আশা ভোসলে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কুমার শানুর গান ছাড়াও রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
ইতিমধ্যে ঢাকায় যেয়ে শিল্পী কুমার শানুর সহযোগতিায় দু’টি গান রেকর্ড করেছে সুতপা। সুবিধাবঞ্চিত, আধুনিকতার ছোঁয়া ছাড়া পরিবেশে সহপাঠী, শিক্ষক, প্রতিবেশি ও স্বজনদের উৎসাহে গানের ডালি ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে সুতপা।
কোদণ্ডা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী (নিউ টেন) সুস্মিতা বাইন ও হাসনা হেনা বলেন, সহপাঠি সুতপা মণ্ডলের গান তাদেরকে মুগ্ধ করে। সুতপার গানের জগতের পরিধি সম্মান বাড়াচ্ছে স্কুলের, কোদণ্ডা গ্রামের, আশাশুনি উপজেলা, সাতক্ষীরা জেলাসহ সারা দেশের। সুতপার মত সহপাঠিকে পেয়ে তারা যার পর নেই গর্বিত। তাকে আরো বড় র্শিপী হিসেবে দেখতে চায় তারা।
প্রতিবেশী শিক্ষক শিক্ষক শ্মশান বাইন ও বিশ্বনাথ সরকার বলেন, গ্রামের বাইরে যেখানে যাই সেখানেই শুনি সুতপার গানের কথা। সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সুতপা আরো প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই তাদের কামনা।
নিজের শিল্পী স্বত্বাকে মেয়ে সুতপার মাধ্যমে তুলে ধরতে চান সুতপার বাবা কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইউনিয়নের ঘোনা ছিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মৃণাল মণ্ডল। একইভাবে নিজের কাজের পাশপাশি মেয়েকে লেখাপড়া ও গানে সহযোগিতা করে থাকেন মা সুমনা মণ্ডল। সুতপার বন্ধু, প্রতিবেশী , শিক্ষক ও স্বজনরা বাড়িতে সুতপার গান শুনতে এলে গর্বে মন ভরে যায় মায়ের।
আশাশুনীর কোদণ্ডা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণীর ছাত্রী সুতপা মণ্ডল বলে, মোবাইল ফোনে গান শুনে তার গান গাওয়া শুরু। বাবা শিল্পী হয়েও বেশিদূর এগোতে না পারায় লেখাপড়ায় ভাল রেজাল্ট নিয়ে চাকুরি না করে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে চায়। সে তার সহপাঠী, শিক্ষক, প্রতিবেশী ও স্বজনদের আশীর্বাদ প্রার্থী। লতা মুঙ্গেশকরের গান তার বেশি পছন্দ। পড়াশুনা ও গানের পাশাপাশি মাকে রান্নার কাজে সহযোগিতা করে থাকে।
আশাশুনির কোদণ্ডা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক অশোক মণ্ডল খুলনা বেতারের দীর্ঘদিনের শিল্পী। সুতপার গানের প্রতিভা নজরে আসায় তিনি সার্বিকভাবে তাকে ভাল করে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পাশপাশি সঙ্গীত শেখায় সহযোগিতা করেন। সুতপাকে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হতে বর্তমান সরকারের কাছে সব ধরণের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
প্রত্যন্ত অঞ্চল আশাশুনির কোদণ্ডা দক্ষিনপাড়ায় যেখানে এখনো ডিস লাইন (কেবল অপারেটর) পৌঁছাইনি, নেই কোন সঙ্গীত একাডেমী সেখানকার মেয়ে সুতপা সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সাতক্ষীরা ও দেশকে বিশ্বের দরবারে আরো পরিচিতি এনে দেবে এমনটি প্রত্যাশা স্থানীয়দের।