চলে গেলেন সুরসম্রাট সুর স্রষ্টা আলাউদ্দিন আলী। দীর্ঘ দিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে অবশেষে ৯ আগষ্ট চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
অনেকেই ওনাকে লিজেন্ড, কিংবদন্তি বলবেন কিন্তু আমি বলি সুরসম্রাট। এ ছাড়া আর কিইবা বলার আছে। সংগীত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষটি হৃদয় থেকে উঠে আসা সুর কথায় বসিয়ে নিয়ে অসম্ভব সুন্দর অর্কেস্ট্রেশন করতেন। তাতে তাঁর প্রতিটি গান অন্য উচ্চতায় চলে যেতো।গানের পেছনে হার্মোনাইজ বা হামিংয়ের ব্যাবহার তিনিই বেশি করে চালু করেছিলেন। তাঁর অর্কেস্ট্রেশন এর পিস তুলতে বাঘা বাঘা মিউজিশিয়ানদের ঘাম ছুটে যেতো।ওনার সুরে আমি কোলকাতা ছবিতেও গেয়েছি।সেখানে রেকর্ডিং স্টুডিওর সবাই তাঁর গান এবং মিউজিক শুনতে শুনতে দাঁড়িয়ে যেতো। সব আলীদা আলীদা করে অস্থির হয়ে যেতো।
একজন আলাউদ্দিন আলী আর একজন শাহনাজ রহমতুল্লাহ জুটি মিলে যে অসাধারণ গান তৈরি হয়েছে একের পর এক তা এক কথায় অনবদ্য। তেমন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আব্দুল হাদি, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, মিতালী মুখার্জি এনাদের সাথেও আলাদা আলাদা এপিসোড তৈরি করেছেন। প্রতিটি এপিসোডই ইউনিক! আলাউদ্দিন আলী এবং আমজাদ হোসেন ও একটি মূল্যবান জুটি ছিলেন বটে।
শেষ কোরোনা শুরুতে খেলা এটাও যেমন তার অনবদ্য সৃষ্টি তেমনি তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে কান্দাইয়া গানটিও আরও অনবদ্য। একটা সময় ছিলো প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে দারুণ সুন্দর মৌলিক গান উপহার দিতেন।
আমি খুব সৌভাগ্যবান যে জীবনের প্রথম প্লেব্যাক আমার শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন আলী ভাইয়ের গানে।মাত্র সাড়ে পনেরো বছর বয়স আমার, আলাউদ্দিন ভাই কত বড় সুরকার,প্লেব্যাক করা কত ভাগ্যের ব্যাপার এগুলো না বুঝেই বাবা মায়ের সাথে গেলাম তাঁর খিলগাঁও এর বাসায় গান তুলতে। বিধাতা ছবির একক গান।গান তোলার সময় আপন কভু পর হয়নারে, এই হয়নারে জায়গাটা এতো সুন্দর করে গাচ্ছিলেন আমার এখনো কানে বাজে। দুনিয়ায় কঠিন কঠিন গান শেখা মেয়ে আমি,এই ছোট একটা জায়গা হচ্ছিলো না।আলী ভাই হাস্যচ্ছলে বললেন তোমার বাবা তোমাকে একটু বেশি শিখিয়ে ফেলেছেন। ছবির গানে এতো কারুকাজ দরকার নেই।তুমি কিছু কারুকাজ ভুলে গিয়ে গানে আবেগ আনো।
খুব উৎসব প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি।বেশীরভাগ সময় স্রুতিতেই রেকর্ডিং করতেন। রেকর্ডিং-এর দিন উনি স্টুডিওটাকে পিকনিক স্পট বানিয়ে ফেলতেন। প্রায় সময়ই উনি বলতেন কনক তুমি রান্না করে এনো।আমি খুশি হয়েও বলতাম আলী ভাই আমি গানই গাইবো নাকি রান্না করবো। আলী ভাই বলতেন তুই রান্নাও করবি গান ও গাইবি।আমার রান্না তাঁর অসম্ভব পছন্দ ছিলো। আমাকে তিনি মা ডাকতেন। কনক ও ডাকতেন কিন্তু বলতেন তুই তো আমার মা! এ আমার পরম সম্মান।
উনি স্টুডিওর কর্মচারী, যারা প্লেব্যাক এ কোরাস গাইতেন তাঁদের খুব ভালোবাসতেন। চেষ্টা করতেন সব গানে কোরাস শিল্পীদের রাখতে যাতে তাঁদের একটু সচ্ছলতা আসে আর এতো রান্নাবাড়ার আয়োজনের আড়ালে থাকতো রয়ে যাওয়া বাকি খাবার যেন স্টুডিওর কর্মচারীরা আরও দুদিন জ্বাল দিয়ে রেখে রেখে খেতে পারে।এতো বড় কিংবদন্তি সুরকার অথচ কত সুক্ষ্মদর্শী ভাবনা!
আমাকে দিয়ে সবাই মেলোডিয়াস গানই গাওয়াতো।আলী ভাই-ই প্রথম আমাকে রক ঘরানার গান আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে গাওয়ালেন। আমি গান তুলে বললাম আলী ভাই আমি পারবো? উনি বললেন সেটা আমার চিন্তা, তোমার না।এরপর এরকম গান আমি অনেক গেয়েছি।উনি গানের মাধ্যমে আমাকে রোজ রোজ পরীক্ষা নিতেন, শক্ত সে সব পরীক্ষা। আমি উৎরাতে পেরেছি কিনা জানিনা!
ওনার জন্মদিন উনি খুব ঘটা করে পালন করতেন। ওনার খিলগাঁও এর বাসা, উত্তরার বাসা এবং স্টুডিও কতো জায়গাতেই তাঁর জন্মদিনের উৎসব হয়েছে! কত রান্না কত খাওয়া কত গান হয়েছে! আমাদের আরেকজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী শ্রদ্ধেয় লিনু বিল্লাহ, ওনার বাসায় আমাদের গানের আসর বসতো।সেখানে আমাদের সাথে আলী ভাই ও গাইতেন! আহা! কি গায়কী! ওনার কণ্ঠে “যেভাবেই আছি বেঁচে তো আছি “গানটি যতবার শুনেছি ততবার আমরা একঘর শিল্পী দলবেঁধে কেঁদে উঠতাম!
খুব সৌখিন মানুষ অনেক সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করতেন। ভালো কিছু উপহার দিলে খুব খুশি হতেন। শেষ জন্মদিনে গেছি ওনার বনশ্রীর বাসায়। ওনার জন্মদিন। শাহনাজ আপা ছিলেন সেদিন। দুজনে মিলে কতো গান কতো স্মৃতি শেয়ার করলেন। এগুলো আমাদের কাছে মনি মুক্তো,যে কুড়াতে জানে সে পায়!
বছর দুয়েক আগে,আমার ছেলের বিয়ে ২৪ ডিসেম্বর, ফোন দিয়ে বললাম আলী ভাই আপনাকে আসতেই হবে।উনি আমতা আমতা করছিলেন। আমি বললাম আলী ভাই সারপ্রাইজ আছে।যাইহোক আমি বিয়ের কর্মযজ্ঞের মাঝেও কেক কিনলাম। এবং মাশুকের বিয়ের মঞ্চের পাশেই ওনার জন্মদিনের কেক কাটলাম।সব শিল্পীরা ওনাকে ঘিরে ওনার গান গাইতে থাকলো! সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো। আলী ভাই কেঁদে ফেললেন। বললেন মারে! তুই আসলেই আমার মা!
সারাজীবন তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ কে অকাতরে দিয়ে গেছেন। অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন কিন্তু আরও পুরষ্কার পাওয়া তাঁর বাকীই রয়ে গেলো। আমি মরোণত্তর পুরষ্কারে একদম বিশ্বাসী নই।যাইহোক।
আমি খুবই ভাগ্যবান মানুষ। ছয় বছর বয়সে রেডিও বাংলাদেশ এর ছোটদের অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন আলী ভাইয়ের সুরে ছড়া গান গেয়েছি, আহা,যদি আমার সে গান সংগ্রহে থাকতো!
আমার একটা প্রস্তাব আছে,বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের জন্য মিউজিক কলেজে বা নতুন কোন গানের ইন্সটিটিউট এ শুধু আলীভাইয়ের গান এবং অর্কেস্ট্রেশন এর শাখা খোলা হোক।তাতে তাঁকেও সম্মান জানানো হবে আর আমাদের নতুন প্রজন্ম ও এই সুরসাগরের কিছুটা জানতে পারবে।
আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত জায়গায় রাখুন।আমি তাঁর শোকসভা পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।