৩৩ টি মানুষ খেকো বাঘ শিকার করে বিশ্বের সেরা শিকারীর স্থান দখল করেছেন ইংলিশ (ইংরেজ) শিকারী জিম করবেট। অথচ সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের পচাব্দী গাজী ৫৭ টি মানুষ খেকো বাঘ শিকার করেছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দখল করার কথা পচাব্দী গাজীর থাকলেও শুধু মাত্র আঞ্চলিকতার কারনে সেই স্থান দখল করতে পারেননি।
তারপরেও এশিয়ার বিখ্যাত বাঘ শিকারী হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন সাতক্ষীরা প্রত্যান্ত অঞ্চলের গাবুরায় জন্ম নেওয়া পচাব্দী গাজী। তিনি যে বন্দুক দিয়ে শিকার করতেন সেই ঐতিহাসিক বন্দুকটি স্বচক্ষে দেখতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ঘুরে গেলেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম। ৩ মার্চ তিনি হেলিকপ্টার থেকে নেমে সরাসরি শ্যামনগরে আসেন। এসময় তাকে অভিনন্দন জানান সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম ও নীলডুমুর ১৭ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াসিন চৌধুরী।
পরে তিনি শ্যামনগর থানায় রক্ষিত ঐতিহাসিক সেই বন্দুকটি দেখেন। বিখ্যাত বাঘ শিকারী পচাব্দী গাজী এই বন্দুক দিয়ে ৫৭ টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করছিলেন। মানুষখেকো এইসব বাঘগুলিকে হত্যা করার জন্য পচাব্দী গাজী বিভিন্ন সময় পুরস্কৃত হয়েছেন। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পচাব্দী গাজীকে বেঙ্গল টাইগার নামে অভিহিত করছিলেন। পচাব্দী গাজীর মৃত্যুর পর তার ব্যবহৃত বন্দুকটি উত্তরাধিকারসূত্রে তার পুত্র আবুল হোসেন পাওয়ার পর বন্দুকটি রিনিউ না করার কারণে শ্যামনগর থানার অস্ত্রাগারে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে পড়ে আছে। ঐতিহাসিক এই বন্দুকটি একনজর চোখে দেখার জন্য বিজিবি মহাপরিচালকর এই সফর।
এ সময় তিনি বিজিবির অফিসার ও সৈনিকদের উদ্দেশ্য বলেন, সীমান্ত রক্ষায় তাদেরকে আরো তৎপর হতে হবে। মাদক, নারী পাচার ও চোরাচালানের ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়া হবে না।
পচাব্দী গাজীর বাঘ শিকারের বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস :
পচাব্দী গাজী বিখ্যাত বাঘ শিকারী। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী শিকারী পরিবারে ১৯২৪ সালে জন্ম। সবাই তাকে পচাব্দী গাজী নামে চেনে কিন্তু তার প্রকৃত নাম আব্দুল হামিদ গাজী। স্বল্পশিক্ষিত মানুষটি ছিলেন রোগা- পাতলা। পিতা মহর গাজী, পিতামহ ইসমাইল গাজী ছিলেন খ্যাতনামা শিকারী। তার পিতা মহর গাজী ৫০টি বাঘ শিকার করার গরব অর্জন করছিল। ১৯৪১ সাল মাত্র সতরো বছর বয়সে খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার ‘গোলখালির সস্ত্রাস’ নামে পরিচিত একটি নরখাদক বাঘ হত্যা করার মাধ্যমে পচাব্দী গাজীর শিকারী জীবন শুরু হয়। শিকারের জন্য উত্তরাধিকার সূত্র তিনি লাভ করেন পিতার ডাবল বেরেল মৌজল-লোডিং বন্দুকটি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও বাংলার সে সময়ের গভনর্র মোনায়েম খা এবং জার্মান চ্যান্সলরের সুন্দরবন পরিদর্শন গাইড হিসেবে কাজ করেন এবং পুরস্কৃত হন। এছাড়া তিনি নেপালের প্রয়াত রাজা মাহেন্দ্র ও তার ছেলে প্রয়াত বীরদ্রকে নিয়ে শিকার অভিযানে যান। তিনি জীবনে অনেকগুলো নামি-দামি সার্টিফিকেট ও স্মারক লাভ করেন। পশুশিকার তাঁর বুদ্ধিমত্তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন বনকর্মকর্তার উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে তিনি বনবিভাগের অধীনে বনপ্রহরীর কাজে যোগদান করেন। এ কাজে যোগদানের পরপরই শুর হয় দুধর্রর্ষ বাঘের সঙ্গে তাঁর বিচিত্র লড়াইয়ের লোমহর্ষক জীবনের এক নতুন অধ্যায়। তিনি সরকারের বনবিভাগের বধ শিকারীর সার্টিফিকেট নিয়ে সুন্দরবনের বাওয়ালি , মাওয়ালি, মাঝি ও জেলেদের জীবনরক্ষায় অবতীর্ণ হন মুক্তিদাতার ভূমিকায় এবং রক্ষা করুন অজস্র শ্রমিকের প্রাণ। তাঁর এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে তাঁকে ‘সনদ-ই-খেদমত’ জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে। পচাব্দী গাজীর বাঘ শিকার করার কৌশল ছিল অন্যদের থেকে স্বতন্র। বাঘকে বশীভূত করার উদ্দেশ্যে তিনি অলৌকিক পদ্ধতির পরিবর্তে আত্মাদ্ভাবিত বিভিন্ন কৌশল,গভীর ধীশক্তি ও প্রযুক্তির আশ্রয় নিতেন। তিনি পারমার্ক দেখে বাঘের আকৃতি অনুধাবন করতে পারতেন। তাছাড়া পদচ্ছাপ দেখে পশুর শ্রেণি এবং তার গতিবিধি নির্ণয়েও তিনি দক্ষ ছিলেন। বাঘের গতিবিধি চিহ্নিতকরণে তিনি কখনও দিন-রাত পর্যবেক্ষণে থাকতেন। তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় ও হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে লড়েছেন। বাঘিনীর ডাক, গাছ কাটার শব্দ কিংবা পাতা সংগ্রহের শব্দ নকল করে তিনি বাঘকে প্রলুব্ধ করতেন। জঙ্গলে কল পেতে কিংবা ১৫ হাত উঁচু মাচান তৈরি করেও তিনি শিকার করতেন। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্তে পূর্ণিমা-অমাবস্যা হচ্ছে বাঘের প্রজনন সময়। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘স্যাঁড়াসাঁড়ির কাটাল’। এ সময় পচাব্দী গাজী বাঘিনীর ডাক নকল করে পাগলপ্রায় মিলনান্মত্ত বাঘকে হত্যা করতেন। পচাব্দী গাজীর বাঘ শিকারের আরো দুটি পদ্ধতি হলো ‘গাছাল’ ও ‘মাঠাল’। গাছাল হলো গাছে চড়ে শিকার, আর মাঠাল হলো জঙ্গলের ভিতর চলতে চলতে শিকার। মাঠাল পদ্ধতিতে শিকার করে তিনি একটি দো-নলা বন্দুক পুরস্কার পান। সাতক্ষীরার বুড়ি গোয়ালিনী ফরেস্ট রেঞ্জ ‘আঠারাবকি’ এলাকায় ‘টোপ’ পদ্ধতিতে তিনি যে বাঘটি হত্যা করেন সেটি ছিল সুন্দরবনের শিকারের ইতিহাস দীর্ঘতম বাঘ প্রায় ১২ ফুট দীর্ঘ। এরপর ‘তালপট্টির সস্ত্রাস’ নামে খ্যাত বাঘ শিকার ছিল পচাব্দী গাজীর জীবনের ৫৭তম ও শেষ শিকার। ৫৭টি রয়েল বঙ্গল টাইগার শিকার করে তিনি সুন্দরবনের ইতিহাস হয়েছেন এবং শ্রেষ্ঠ শিকারির খেতাব নিয়ে ১৯৯৭ সালে মারা যান।